[ক]

১. বদর যুদ্ধে কাফিরদের পক্ষে স্বয়ং শয়তান সুরাকা বিন মালিকের আকৃতি ধারণ করে বিশাল বাহিনী নিয়ে বনি মুদলিজ গোত্রের পুরুষদের বেশ ধারণ করে শরীক হয়েছিল।

বিপরীতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হযরত জিবরীল, হযরত মিকাইল এবং হযরত ইসরাফিল আ.-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের একটি বাহিনী মুসলিম সেনাদলে যুক্ত করেন। যুদ্ধের মজা এবার বুঝে নিক।

২. ফেরেশতাদেরকে যুদ্ধনীতি আল্লাহ নিজেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। শত্রুকে কোথায় আঘাত করতে হবে তাও বলে দিয়েছিলেন। "তোমরা তাদের ঘাড়ে এবং আঙুলের অগ্রভাগে আঘাত করো।" (আনফাল-১২)

যদ্দরুন লাশ দেখে চেনা যেতো, কে সাহাবীদের হাতে নিহত, আর কে ফেরেশতাদের হাতে নিহত। যারা ফেরেশতাদের হাতে নিহত হয়েছিল তাদের ঘাড় এবং আঙুলের অগ্রভাগে পোড়া দাগ ছিল। পুড়ে ছাই। আহ কী যন্ত্রণা!

৩. উবায়দা রা.-এর প্রতিপক্ষ উতবা।
হামজা রা.-এর প্রতিপক্ষ শায়বা।
আলি রা.-এর প্রতিপক্ষ ওলীদ।

যুদ্ধ শুরু। শুরু আক্রমণ। প্রথম আক্রমণেই হামজা এবং আলি রা. তাঁদের প্রতিপক্ষকে খতম করে দিলেন। কিন্তু উবায়দা রা. নিজে আহত হলেন। উতবার তরবারির আঘাতে পায়ের রগ কেটে যায়। রক্তাক্ত হন। ঐদিকে উতবাও আহত হল। হযরত হামজা এবং আলি রা. কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজেদের কাজ সেরে উবায়দা রা.-এর শিকারিকে খতম করতে এগিয়ে এলেন। দুজনের উপর্যুপরি আঘাতে নরাধম উতবা নিহত হয়। কোথায় গেল তাদের মাস্তানি?

৪. বদর যুদ্ধের অনেক আগে হযরত সা'দ বিন মু'আজ রা. উমাইয়া বিন খলফকে বলেছিলেন, "তুমি আমাদের হাতেই নিহত হবে। প্রস্তুত হও। বেশি বেড়ে গেছো।"

বদর যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলে তার সেই কথা মনে পড়ে গেল। একটা ভয় কাজ করতে লাগল। বাতিল সমসময় কাপুরুষ হয়। তলেতলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, "না, বদরে অন্তত আমি অংশগ্রহণ করব না। ছলেবলে পিছনে থেকে যাব।"

এদিকে আবু জাহাল নাছোড়বান্দা। উমাইয়াকে না নিয়ে যুদ্ধে যাবে না। আল্লাহর পরিকল্পনা এমনই হয়। নিখুঁত এবং সাজানো গোছানো। শেষমেশ যেতেই হল। বদর প্রান্তে তাকে প্রথম দেখেন তার হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হযরত বেলাল রা.। তিনি দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠেন, "ঐ যে উমাইয়া। ভাইয়েরা! তোমরা তাকে হত্যা করো।" একথা শুনে সবাই একযোগে আক্রমণ করে উমাইয়াকে হত্যা করলেন। যেই বিলাল রা.-কে তপ্ত রোদে ফেলে চামড়া খসিয়ে দিয়েছিল সেই দাসের হুকুমেই তাকে এভাবে মরতে হবে তা কি সে বিশ্বাস করেছিল? দূর, তার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কী আসে যায়? প্ল্যান তো আসমানে হয়।

৫. আব্দুর রাহমান বিন আউফ রা.-এর ডানেবামে দুই আনসার কিশোর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের একজন চুপিচুপি বললেন,

চাচা! আবু জাহেল কোনটা?
বৎস! তাকে চিনে তুমি কী করবে?

আমি তাকে পেলে হত্যা করব এবং আমি নিজেও শহীদ হব। আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা এটি। কারণ আমি শুনেছি, সে নাকি আল্লাহর রাসূল সা.-কে গালিগালাজ করেছে। তাকে না মেরে আমার নিস্তার নেই।

এবার আব্দুর রাহমান বিন আউফ রা.-আঙুলের ইশারা দিয়ে বললেন, "ঐযে, ঐটাই আবু জাহল।"

শনাক্ত করতে দেরি, বাজপাখির মতো শিকারির ওপর দুই সহোদরের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি হয়নি। অসীম সাহসিকতায় আবু জাহলকে হত্যা করে দুই কিশোর অনন্য নজির স্থাপন করলেন। তাঁরা ছিলেন হযরত আফরা রা.-এর দুই পুত্র মু'আয এবং মু'আউয়ায রা.

৬. সুতরাং বদরের যুদ্ধের ঘটনা পড়লেই হবে না, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। নিজের সন্তানদেরকে মু'আয এবং মু'আউয়াযের রা.-এর রঙে রাঙাতে হবে। নিজেদেরকে হতে হবে অকুতোভয়। বাতিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ন্যায়ের পক্ষে আপোষহীন। তবেই নিজেদের ঔরসে জন্ম নিবে মু'আয এবং মু'আউয়াযের মতো হিরকতুল্য সন্তান। আর যদি নিজেরা হই 'মিউমিউ' ঘরানার তাহলে সেই ঘরে সিংহের গর্জন দেওয়ার মতো সন্তান তৈরি হবে কী করে?

[খ]

রক্তাক্ত বদর প্রান্তর। মক্কার আবু জাহলের অনুসারী আর মদিনার মুহাম্মদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথিদের মধ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। মারমুখী মুসলমানদের ঠেকানো দায়! কচুকাটা করে চলছেন কাফেরদের। মাত্র ৩১৩জন মুসলমান ১০০০ কাফেরের জন্য মৃত্যুর যমদূত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। চোখে শর্ষেফুল দেখছে লাত, মানাত, উজ্জা আর হুবলের পূজারীরা।

মক্কা হতে তাড়িত, মদিনায় আশ্রিত, সদা জঠরজ্বালায় মুহ্যমান, খেজুরপাতার ছাউনিঘেরা জীর্ণশীর্ণ কুটিরে বিনিদ্র রজনী যাপনকারী, মোটা সুতার কাপড় পরিধানকারী, সহায় সম্বলহীন গুটিকতেক মানুষ কীসের বলে বলিয়ান হয়ে তখনকার সময়ের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত মক্কার অভিজাত শ্রেণির সহস্র যোদ্ধার জন্য মৃত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, তা আজও রীতিমত গবেষণার ব্যাপার!

আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ রা. সেদিন আবির্ভূত হয়েছিলেন এক মারকুটে সৈনিকের ভূমিকায়। তাঁর বেপরোয়া আক্রমণে কাফির বাহীনি হতচকিত হয়ে পড়ে। সেদিন তিনি ছিলেন মৃত্যুর প্রতি উদাসীন এক বেপরোয়া বীর। তাঁর ভয়ানক আক্রমণে কাফেরদের অশ্বারোহী সৈনিকেরা প্রাণের ভয়ে দিশেহারা হয়ে দিক্বিদিক পালাতে থাকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কাফেরদের এক বীর তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তিনি তার চেহারা দেখেও না দেখার ভান করে ভিন্ন দিকে আক্রমণ করেন। এ ব্যক্তি সেখানে গিয়েও তাঁর সামনে দাঁড়ায়। তিনি আবারও দিক পরিবর্তন করে অন্যদিকে আক্রমণ করেন। কিন্তু এই একই ব্যক্তি ওখানে গিয়েও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে! এবারও তিনি অন্যদিকে মনযোগ দেন। চাইলেই তিনি এক আঘাতে এই একঘুয়ে কাফেরের ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি; শুধুই ছাড় দিয়েছেন।

হঠাৎ আবু উবায়দাহ রা. দেখলেন, এই ব্যক্তিটা সুযোগ বুঝে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খুন চেপে বসে তাঁর মাথায়! চটজলদি তিনি হামলে পড়েন ওই ব্যক্তির ওপর। শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে দিলেন প্রচণ্ড একটি কোপ। মুহূর্তেই সে ব্যক্তির ধড় থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে মাটিতে! ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ভিজে যায় বদরের বালুকাময় প্রান্তর। ডাঙায় তোলা চুনোপুঁটির মত মস্তকহীন ধড় তড়পাতে থাকে!

ভীতিকর এই দৃশ্য দেখে শত্রু বাহিনী চরমভাবে হতাশ ও ভীত সন্তস্থ হয়ে পড়ে। কেননা মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়, এই ব্যক্তিটা যে স্বয়ং আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.- এর জন্মদাতা পিতা আবদুল্লাহ বিন জাররাহ! ছেলের হাতে পিতার নির্মম খুন দেখে কাফেররা একেবারে ভড়কে যায়! তারা তাদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না! তাদের ভয়ার্ত ও বিস্ময়াভিভূত চাহনি এটাই বলছিল যে- এটাও কি সম্ভব?!

তিন তিনবার পিতাকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেও না দেখার ভান করলেন আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ রা.। বাপের ওপর তলোয়ার উঠাতে বুক বাঁধল তাঁর। বাপের একঘেয়ে দুঃসাহসকে মোটেও পাত্তা দেননি। কিন্তু রাসুলের ওপর চড়াও হতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। মুহূর্তেই বাপ-বেটার সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। ভবলীলা সাঙ্গ করে ফেলেন বাপের!

একেই বলে রাসুলপ্রেমের নজরানা। আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআ।

আল্লাহর জন্যই কাউকে ভালবাসা আর কাউকে অপছন্দ করা। আবু উবায়দাহর এই কাজটা বড় ভাল্লাগে আল্লাহর। সাত আসমানের উপর থকে ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ করে অবতীর্ণ করে ফেলেন সুরা মুজাদালাহর ২২ নং আয়াতখানা :

(لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءهُمْ أَوْ أَبْنَاءهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُوْلَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُوْلَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ)

[যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।]

সূত্রাবলি :

*আল-মুজামুল কাবির : ১/১৫৪, ইমাম তাবরানি।
*মারিফাতুস সাহাবাহ : ১/১৪৯, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানি।
*আল-মুস্তাদরাক : ৩/২৬৪, হাকিম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরি। 
*তারিখু দিমাশক : ৭/১৬১, ইমাম ইবনে আসাকির।
*ফাতহুল বারি : ৭/১১৭, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি।


Sources: [ক] [খ]