হিমু।

বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত সবচাইতে জনপ্রিয় চরিত্র। বই পড়ুয়া সব ছেলেই জীবনে কখনো না কখনো হিমু হতে চেয়েছে, আর মেয়েরা হতে চেয়েছে রূপা। হিমুর সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক, যেটা অবচেতনভাবে সবাইকে টানে, সেটা হচ্ছে তার করতে থাকা ভালো কাজগুলো। সে গরীবদের সাথে সহজে মিশে যায়। সে নিজেও গরীব। মানুষের উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে তার জুড়ি নেই। মোটকথা, মানুষ হিসেবে তাকে একজন ভালো কাজ করতে থাকা মানুষ বলা যায় (যদিও জীবনের আসল উদ্দেশ্য আরো অনেক অনেক বড়)। সে মিসির আলী আর শুভ্রর চাইতেও বিখ্যাত। কারণ হচ্ছে তার উদ্ভট কর্মকান্ড। সে প্রায়ই গোসল করে না। এত নোংরা চলাফেরা করে যে প্রায়ই তার শরীর হতে উৎকট গন্ধ বের হয়। আরো বলতে পারি, বাট ওকে নিয়ে ঋণাত্মক কথা ফাঁদতে এই লেখাটা লিখছি না। আসল কারণ অন্য।

আমি নিজে ওর ভয়াবহ ফ্যান ছিলাম। কেমন ফ্যান বলি। ওর সম্পূর্ণ সমগ্র ৪৫০টাকা দিয়ে যখন কিনে এনেছিলাম, তখন আমি ইন্টারে পড়ি। টিউশানি করে নিজের খরচ নিজে ম্যানেজ করার ট্রাই করি, তবুও পোষায় না। প্রায়ই লজ্জিত অবনত মুখে মিনমিন করে আব্বুর কাছে হাত পাততে হয়। কী লজ্জা! কী লজ্জা!! ১৫ বছর বয়সী ঝকঝকে তরুণ ছেলে হয়ে আব্বুর ঘাড়ে বসে খাওয়ার মতো লজ্জা দুনিয়াতে আর কী হতে পারে? তার উপর টাকার জন্যেও প্রায়ই আব্বুর কাছে হাত পাতা। আমার পৃথিবী লজ্জায় আরক্তিম হয়ে যেতো। ঠিক এইরকম দুঃসময়ে গোটা ৪৫০টা টাকা (আম্মুর ভাষায়) ‘ফেলে দিয়ে’ একটা ‘আউট বই’ কিনে আনা, যেটার সবগুলো বই-ই আমি আগেও কয়েকবার করে পড়েছি, এরকম ভয়াবহ বিলাসিতার মতো জঘন্য অপরাধ আর কী হতে পারে? সেইদিন লজ্জায় আর আম্মুর সামনে যাইনি। লুকিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছি। তার উপর আমার পিচ্চি লাইব্রেরীর এই একটা মাত্র বই-ই কারো বাসায় নিয়ে পড়ার অনুমতি ছিলো না, নেই।


দিন বদলেছে। নাস্তিকতার নিঝুম অন্ধকারে ঢাকা ঘন অরণ্য পেরিয়ে তখন সবেমাত্র ইসলামের অসাধারণ সবুজের মখমলে ঢাকা অপরূপ পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছেছি। সারা গায়ে অরণ্য পেরিয়ে আসা ক্লান্তি আর কাঁদা জড়ানো। পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঝরঝর করে বইতে থাকা তাওবার ঝরণাতে সব কাঁদা আর ক্লান্তি ধুয়ে নিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার স্বপ্ন দুই চোখে। প্রথম পদক্ষেপ যেদিন রাখলাম, সাথে সাথেই চারপাশ বদলে গেলো। বন্ধু হারালাম, হারালাম চারপাশের প্রায় সব মানুষগুলোকে। শরীরের পোষাকে মোড়ানো এই ‘আমি’, আমার ‘রূহ’, বুঝতে পারলাম, আমি কত্ত একা। সবাই-ই এই সত্যটা জানে, অনুভব করেছে একবার হলেও। এই আমি (রূহ) এসেছি একটা মিশনে, একটা সফরে। মুসাফির এই আমি (রূহ) কত কিছু নিয়ে জাঁকিয়ে ব্যবসা করতে বসে গিয়েছি সফরের মিশন ভুল মেরে। ভুলে গিয়েছি, বারবার ভুল মেরে যাই, আমি একা। সবাই একা। একা যেদিন আবার ট্রেইনে উঠে যাবো, সেইদিন সব, একদম সব রেখেই, এমনকি পরনের কাপড়টাও ফেলে ট্রেইনে উঠে পড়তে হবে। সাথে যাবে শুধু আমার আসল ঠিকানায় (আখিরাতে) পাঠিয়ে দেয়া সম্পদগুলো, ভালো আর খারাপ কাজগুলো। সবই জানি। তবু, স্মরণিকার অভাবে প্রতিদিনই ভুল মেরে বসি। প্রতিদিন। প্রতিদিনই তাই আবার সেই তাওবার ঝরণায় ভিজে পরিষ্কার হওয়ার জন্যে নেমে আসতে হয়। আবার হাঁটা শুরু হয় নতুন করে।

বই পড়ার রুচি এর মাঝে আমূল বদলে গেলো। জাফর ইকবালের বইয়ের পাতায় লুকিয়ে থাকা (জামায়াত বিরোধীতার নামে) ভিলেন হিসেবে প্রায়ই দাড়ি টুপিওয়ালা মুসলিমদের নিয়ে লেখা ইসলাম বিদ্বেষ বড্ড গায়ে লাগে। হুমায়ুন আহমেদের অবৈধ প্রেম নিয়ে এত এত লেখা বইগুলো আর ছুঁয়ে দেখার রুচি হয় না। কত শত অসাঢ় উপন্যাস এখনো প্রকাশিত হয়। পড়তে ভালো লাগে না। কিছুই শেখার নেই, কিছুই জানার নেই। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার পাহাড়ে কেবলই বালখিল্যতা আর আদিখ্যেতা। অর্ধেক জীবন যে অর্থহীনতায় ফেলে এসেছি, সেই স্মৃতি কেবলই কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে চলে। কিছু একটা করতে হবে। জানতে হবে অনেক, করতে হবে আরো বেশি কিছু। অনেক পড়তে হবে। সত্যিকারের যেগুলো জানার, জানতে হবে। কাজে লাগাতে হবে নিজের লাইফে, জানাতে হবে অন্যকে। অনন্তের পথের জন্যে যে অনন্ত পাথেয় দরকার সেটা যে আমাদের কারোরই নেই। কারোর না।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় ওয়াইস আল কারণি নামের মানুষটার সাথে পরিচয় আমার। অসম্ভব সাদাসিধা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ের মুসলিম হয়েও উনার সাথে দেখা করতে পারেননি তিনি। নিজের জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার মানুষটার সাথে দেখা হয়নি তার কেবলই নিজের আম্মুর দেখাশোনা করতে গিয়ে। সাহাবী হতে পারেননি। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে কখনো দেখেননি, কিন্তু জানতেন তার কথা (আল্লাহ জানিয়েছেন)। তাইতো দুনিয়া হতে চিরবিদায়ের আগে যখন সাহাবীদের মাঝে একটা নীরব আশার আলো জ্বলছিলো যে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়ের পোশাকটি হয়তো তাকেই দেয়া হবে, তখন আমার নবিজী নিজেই জানিয়ে দিলেন পোশাকটি দিতে হবে ওয়াইস আল কারণীকে। সবাই তো অবাক! কে এই ওয়াইস আল কারণী? কেউ তাকে কোনদিন দেখেনি, নামও শোনেনি। কে এই অসাধারণ আত্মা যাকে না দেখেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এত্ত প্রশংসা করছেন? অবশেষে হজরত ওমর এবং আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা যখন মানুষের মুখে শুনে শুনে এই ‘বোকা আর হতদরিদ্র, অচেনা’ মানুষটিকে খুঁজে বের করলেন, তখন তিনি একটা গাছের নিচে বসে ইবাদত করছেন, চারপাশে অনেক উট।

ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) তার সামনে গেলেন, তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম।

ওয়াইস তার ইবাদত শেষ করে তাদের দিকে ফিরে সালামের উত্তর দিলেন।

তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কে তুমি?

সে বললঃ আমি উট দেখাশোনা করি এবং একটি গোত্রের কাজের লোক।

তারা বললেনঃ আমরা তোমাকে তোমার পশু পালনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি, এমনকি তুমি কোনো গোত্রের কাজের লোক কি না তাও জানতে চাইনি; আমরা জানতে চাচ্ছি তোমার নাম কী?

সে বললঃ আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)।

তারা বললেনঃ এই আসমান এবং জমিনে যতো আল্লাহর সৃষ্টি আছে সবই আল্লাহর বান্দা; কিন্তু তোমার নাম কী যা দিয়ে তোমার মা তোমাকে সম্বোধন করেন?

সে বললঃ তোমরা আমার কাছে কী চাও?

তারা বললেনঃ “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাদেরকে ওয়াইস আল কারণী নামে এক ব্যক্তির কথা বলেছিলেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী সেই ব্যক্তির থাকবে নীলাভ কালো চোখ এবং তার বাম কাঁধের নিচে এক দিরহামের মতো একটি সাদা দাগ থাকবে। তাই দয়া করে আমাদেরকে দেখতে দাও যে তোমার ঐ সাদা দাগটি আছে কিনা। তাহলেই আমরা বুঝবো আমরা যাকে খুঁজছি সে তুমি কি না?

ওয়াইস তখন তার বাম কাঁধ উন্মুক্ত করে দেখালেন, দিরহামের মতো সেই সাদা দাগটি স্পষ্ট ফুটে আছে তার বাম কাঁধের নিচে। ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)-র বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই সেই ওয়াইস আল কারণী যার কথা অনেক অনেক বছর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছিলেন।

তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত। তিনি একটি হাদিসে কুদসি বর্ণনা করেছিলেন (আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে হাসিদটি) যেখানে তিনি বলেন যে, আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতালা ভালোবাসেন তাঁর সৃষ্টিকে যে আল্লাহ ভীরু, যার অন্তর পরিশুদ্ধ, তাদেরকে যারা নিজেদের গোপন রাখে এবং তাদেরকে যারা নিরপরাধ, যার মুখমন্ডল ধূলো-মলিন, যার চুল এলোমেলো, যার পেট খালি এবং সে যদি শাসকের সাথে দেখা করার অনুমতি চায় তাহলে তাকে তা দেয়া হয় না। এবং সে যদি একটু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সে যদি দুনিয়ার কিছু ত্যাগ করে এর অভাব কখনোওই সে বোধ করে না। এবং সে যদি কোথাও থেকে বের হয়ে যায় তাহলে তার বের হয়ে যাওয়াও কেউ লক্ষ্য করে না। সে যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে দেখতে কেউ আসে না এবং সে যদি মারা যায় তাহলে তাকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দিতেও কেউ আসে না।”

এই হাদিস শুনে সাহাবারা (রাঃ) তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ

“ইয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এরকম একজন ব্যক্তিকে আমরা কীভাবে খুঁজে পাবো?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেনঃ ওয়াইস আল কারণী হচ্ছে এমনই একজন ব্যক্তি।

তখন সাহাবারা (রা) জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ কে এই ওয়াইস আল কারণী?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেনঃ তার গাত্র বর্ণ কালো, কাঁধ প্রশস্থ, উচ্চতা মাঝারি, তার দাড়ি তার বুক পর্যন্ত লম্বা, তার চোখ সবসময় অবনমিত থাকে সেজদার স্থানে। তার ডান হাত থাকে তার বাম হাতের ওপর। সে একান্তে এমনভাবেই কাঁদে যে তার ঠোঁট স্ফীত হয়ে যায়। সে একটি উলের পোশাক পরে এবং আসমানের সবাই তাকে চেনে। যদি সে আল্লাহর নামে কোনো শপথ করে, সে তা পালন করে। তার ডান কাঁধের নিচে একটি সাদা দাগ রয়েছে। যখন আখেরাতের দিন আসবে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে বলা হবে জান্নাতে প্রবেশ কর, তখন ওয়াইসকে বলা হবে ‘দাঁড়াও এবং সুপারিশ কর’। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতালা তখন তার সুপারিশ অনুযায়ী ‘মুজির’ এবং ‘রাবিয়া’ (ওয়াইসের দুই গোত্রের নাম) গোত্রের লোক সংখ্যার সমান লোককে ক্ষমা করে দেবেন। সুতরাং হে ওমর এবং আলী, তোমরা যদি কখনও তার দেখা পাও তাহলে তাকে বলো তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াইস সম্পর্কে আরো বলেছিলেন যে, তার ঘরে বৃদ্ধা মা আছে। যার পুরো দেখা শোনা ওয়াইস করেন এবং বৃদ্ধা মাকে দেখা শোনার জন্যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দেখা হওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ ছিল তা গ্রহণ করতে পারেনি।

(ওয়াইস আল কারণী তার মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবি হওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ইসলাম কবুল করলেও তিনি তাবেয়ি রয়ে যান।)

এই ঘটনার পর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর তাদের মাঝে নেই। আবু বকর (রাঃ) ও দুনিয়া ছেড়েছেন। এর মধ্যে শত খোঁজার পরও ওয়াইস আল কারণীকে খুঁজে পাননি তারা। আর আজকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনাকৃত সেই ওয়াইস আল কারণী তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) ওয়াইস আল কারণীকে জড়িয়ে ধরে বললেনঃ “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমিই সেই ওয়াইস আল কারণী। সুতরাং আল্লাহর কাছে আমাদের জন্যে ক্ষমার সুপারিশ কর এবং আল্লাহ তোমাকেও ক্ষমা করুন।”

উত্তরে ওয়াইস বললেনঃ কোনো আদম সন্তান বা নিজেকে আমি ক্ষমা করানোর ক্ষমতা রাখি না, তবে এই জমিনে ইমানদার পুরুষ এবং ইমানদার নারী রয়েছে, মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষ রয়েছে, যাদের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়।

তারা বললেনঃ সত্যিই তাই।

তখন তিনি বললেনঃ আপনারা দুজন আমার সম্পর্কে জানেন এবং আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি, কিন্তু আপনারা কারা?

আলী (রাঃ) তখন ওমর (রাঃ) কে দেখিয়ে বললেনঃ ইনি হচ্ছেন আমিরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এবং আমি হচ্ছি আলী বিন আবু তালিব।

ওয়াইস তাদের পরিচয় শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং তাদের উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম ইয়া আমিরুল মুমিনিন এবং আলী আপনাকেও। আল্লাহ আপনাদেরকে এই উম্মাহর জন্যে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

তারাও বললেনঃ আল্লাহ তোমাকেও উত্তম প্রতিদান দিন।

এর পর ওয়াইস আল কারণী তাদের জন্যে দোয়া করলেন।

ওমর (রাঃ) ওয়াইস আল কারণীকে বললেনঃ “তুমি এখন ইহজীবন এবং পরকালে আমার বন্ধু।”

ওয়াইস আল কারণী জানেন ইহজীবনে ওমরের বন্ধু হওয়া মানে সুনাম এবং একটি স্বচ্ছল জীবন, তাই তিনি ওমর (রাঃ) এর বন্ধুত্ব তো গ্রহণ করলেন কিন্তু খুব বিনয়ের সাথে তার সাথের স্বচ্ছলতা এবং সুনাম যা ওমর (রাঃ) এর মাধ্যমে সে পেতে পারত, সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যেমন আছেন ঠিক তেমনই থাকার ইচ্ছে পোষণ করলেন।

ওমর (রাঃ) বললেনঃ তুমি কোথায় যেতে চাও এখন? ওয়াইস আল কারণী বলেনঃ ইরাকের কুফায়।

ওমর (রাঃ) বললেনঃ ঠিক আছে আমি একটি চিঠি লিখে দেই কুফার গভর্নরকে যাতে সে তোমার ভালো দেখাশোনা করতে পারে।

ওয়াইস বললেনঃ দয়া করে এই কাজ করবেন না। কারণ আমি নিজেকে এইভাবে অচেনা রাখতেই পছন্দ করি। আমি আল্লাহর রাস্তায় এভাবেই অপরিচিত হয়েই থাকতে চাই।

এরপর সে কুফায় চলে যায়। সেখানেই বসতি স্থাপন করে। এইভাবে কেটে যায় আরও কিছু বছর। একবার কুফা থেকে ওয়াইস আল কারণীর গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মদিনায় আসেন। তার কাছে ওমর (রাঃ) ওয়াইস আল কারণী কেমন আছেন তা জানতে চান। খলিফা ওয়াইস আল কারণীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে দেখে সেই ব্যক্তি খুব অবাক হয়, সে খলিফা ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেঃ আমি তাকে দরিদ্রতায় নিমজ্জিত দেখে এসেছি, তার ঘরে কোনো আসবাব নেই, কেন আপনি এই ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস করছেন।

ওমর (রাঃ) এই ব্যক্তিকে বললেনঃ যদি তুমি তার দেখা পাও, তাকে বলো তোমার জন্যে দোয়া করতে কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার কথা বলেছিলেন।

সেই ব্যক্তি কুফায় ফিরে ওয়াইসের সাথে দেখা করে। তাকে বলেঃ ওয়াইস আমার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।

ওয়াইস বললেনঃ তুমি নিজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ তুমি মাত্র সফর করে আসলে। আর মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।

সে বললঃ না না। আমি চাই তুমি আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর।

ওয়াইস আল কারণী একটু চুপ থাকলেন তারপর বললেনঃ “তোমার কি ওমরের সাথে দেখা হয়েছিল?”

সে বললঃ হ্যাঁ।

ওয়াইস আল কারণী বুঝতে পারলেন কী হয়েছে ব্যাপারটা। তিনি কিছু বললেন না। ঐ ব্যক্তির জন্যে দোয়া করলেন।

এই ঘটনা পুরো কুফায় আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল, সবাই জেনে গেল ওয়াইস আল কারণী সম্পর্কে। নিজেদের আল্লাহর দরবারে মাফ করিয়ে নিতে মানুষজন যখন ওয়াইসের খোঁজে তার বাড়ি গেল, দেখলো বাড়ি খালি পড়ে আছে, ওয়াইস নেই। নাম, যশ, খ্যাতি সব কিছু দুহাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে একমাত্র আল্লাহর জন্যে বেঁচেছেন তিনি। তার তাকওয়া, তার মর্যাদা তিনি কারো কাছে প্রকাশ করতে চাননি। একমাত্র আল্লাহর জন্যেই সব করেছেন এবং আল্লাহর কাছ থেকেই ইনশাআল্লাহ তিনি এর বিনিময় পাবেন।

সত্যি ওয়াইস আল কারণী একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি। আর আমার আরেকজন সুপারহিরো।

আমার আর এখন হিমু হতে ইচ্ছে করে না। একজন ওয়াইস আল কারণী হতে ইচ্ছে করে। খুব।

আল্লাহ আমাদের সকল কথা এবং কাজকে সঠিক ইখলাসের চাদর দিয়ে ঢেকে দিন। আমিন।


(শেষের অর্ধেকের বিশাল একটা অংশ এই http://tinyurl.com/m5mtva3 লিংক থেকে হুবহু নেয়া)


10:38 am, November 28, 2014