তখন ডিজ্যুস সিম এসেছে। উঠতি ছেলেমেয়েরা কথা বলছে রাত জেগে, আর দিনের বেলায় ঢুলছে। ডিজ্যুসের অ্যাডগুলোও ওভাবেই বানাতো, যাতে যুবকেরা আকৃষ্ট হয়। জটিল মুড, কঠিন ভাব। বয়েসটাতে ব্যতিক্রম হতে মন চায়। আর দশটা ছেলের মাঝে আমাকে যেন আলাদা করে চেনা যায়। অবশ্য কিছু করারও নাই সেক্যুলার দুনিয়ার। হরমোনগত কারণে ছেলেদের মাঝে নিজেদেরকে মেলে ধরার প্রবণতা কাজ করে। মাথায় তেল দিয়ে ডাইনে সিঁথি করা ছেলেটা হার্ড জেল মেরে সজারু সাজে। হাতে একগাদা ব্যান্ড-ব্রেসলেট। ফর্মালদের ভিড়ে একজন লুজ-ইন বা ব্যাগি জিন্স। এসব তখন কেবল শুরু হয়েছে। একপাল গুডবয়ের মাঝে একজন এলোমেলো, আউলাঝাউলা। ভেড়ার পালে বাছুর পরামানিক। গুনলাম না তোমাদের সমাজকে। হতে চাই না তোমাদের মনের মত।

চেনা এক ভাই। আর্মি অফিসার হিসেবে আইএসএসবিতে সিলেক্টেড হলেন। ৩ দিনের আইএসএসবি পরীক্ষা শেষে ডিপি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ১০ জনের গ্রুপের উদ্দেশ্যে জানালেন এই দশজনের মাঝে একজনের গ্রীনকার্ড মিলেছে, ‘কিন্তু আমি জানি সে আর্মিতে আসবে না, এই তুমি সত্য করে বলতো, ইউ আর সিলেক্টেড এনিওয়ে, তুমি কি আসবে?’ গ্রীনকার্ড পাবার পর বাবামা থেকে নিয়ে পুরো গুষ্টি হামলে পড়ল, বাবা তোমাকে যেতেই হবে, আমাদের দিকে তাকিয়ে হলেও। বাপকে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালামের ভাষায় জানিয়ে দিল: বাবা, আমি আর্মিতে গেলে আর্মি চীফ হব, আর আর্মিতে না গেলে প্রেসিডেন্ট হব, তুমি বল আমাকে কী দেখতে চাও। ব্যাপক পার্ট। তোমরা যেটাকে আরাধ্য মনে কর, আমি সেটাকে ফুটো পয়সার দাম দিই না। আমি উল্টো পথে চলতে চাই। একটা গানের লাইন কি না জানি না, তবে লাইনটা দারুণ—

‘পথ হারাতে আমি যে আজ পথে নেমেছি, সোজা পথের কাদায় আমি অনেক মেখেছি।’

বয়সের কারণে একসময় এগুলো ভালো লাগত। বিষয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের নরম ঔদ্ধত্য আছে, লুকোনো অহমিকা আছে। দুনিয়ার ব্যাপারে বিষয়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ, অহংকার প্রকাশ হয় কিছুটা। কিন্তু দ্বীনের ব্যাপারে এই ‘ড্যাম কেয়ার’ জিনিসটা দারুণ। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের তরবারি ‘জুলফিকার’ হাতে নিয়ে বললেন: কে আছো এই তরবারির হক আদায় করবে? আলী রা. ও যুবাইর ইবনে আওয়াম রা. এর মত বীর বাহাদুর নিজেদেরকে পেশ করলেন। তাদেরকে রেখে নবীজী তরবারি দিলেন আনসারী সাহাবী আবু দুজানা রা.কে। তিনি সৈন্য বাহিনীর সামনে দিয়ে লাল পাগড়ি বেঁধে সেই তরবারি নিয়ে উদ্ধত দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এটা যদি যুদ্ধক্ষেত্র না হত, তবে আল্লাহ এমন হাঁটাকে খুব অপছন্দ করেন।

একদিন একটা ঘটনা পড়ে লোম দাঁড়িয়ে গেল, চোখের পানিতে ভিজে গেল মন। একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাটের কাহিনী, শত্রুজাতির মায়েরা তার ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতো। মনে করেন, ‘চীন আর রাশিয়া দখলকারী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট’ আজকের দুনিয়ায় কেমন আলোচনার টপিক? সেই সম্রাটও তেমনি। পারস্য সাম্রাজ্য আর বাইজান্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্যের মত দুই-দুইটা সুপার পাওয়ার তখন তাঁর কমান্ডে অধিকৃত। আর তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন কমজোর দুর্বল এক জাতির। রোমান দূত এসে খুঁজছেন—

- তোমাদের সম্রাট খলিফা উমারের মহল কোথায়?

- ঐ যে ওদিকে।

ছোট্টবেলা থেকে রাজা, মন্ত্রী, আমলাদের রাজকীয় প্রটোকল দেখে দেখে বড় হওয়া দূতসাহেব বিস্ফোরিত নয়নে আবিষ্কার করেন গাছের ছায়ায় চাটাইয়ে শোয়া সম্রাটকে। রোদ এসে পড়েছে, শরীর থেকে দরদর করে ঘাম, ভিজে গেছে চাটাই। চাবুক বালিশের মত করে রাখা, গভীর ঘুম। দুইটা সুপার পাওয়ার যাঁর অধীনে, আরও সুপার, সেমি-সুপার সবাই থরথর, কবে উমার না আবার এসে পড়ে। বড় আজীব এসব সম্রাট; এ সম্রাটের মহল নেই, দরবার নেই, মুকুট নেই, দাসদাসী পাইকপেয়াদা নেই। এ সম্রাটের সাম্রাজ্য কেবল দুনিয়াতেই না, আখিরাতেও যে বিস্তৃত। খলিফার এই অবস্থা দেখে দূত বেচারার সেই কালজয়ী মন্তব্য: O Umar! You ruled, you were just. Thus you were safe. And thus you slept.

হে উমার! আপনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাই নিরাপদে শুয়ে আছেন। অথচ আমাদের রাজাবাদশাহরা নিরাপত্তার ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনার দ্বীন সত্য। আমি যদি দূত হিসেবে না আসতাম তবে এখনই আপনার দ্বীন কবুল করতাম। তবে আমি পরবর্তীতে এসে ইসলাম গ্রহণ করব। [1]

রাষ্ট্রপ্রধান হবার পর একবার তিনি জনসমক্ষে ভাষণ দিচ্ছিলেন, ১২ তালি দেয়া কাপড়ে। [2] তাওয়াফ করার সময় একজন গুণলেন ১২ টা তালি, একটা আবার লাল চামড়ার। [3] চমকদার পোশাক-প্রাসাদ-দরবার-মুকুট-প্রটোকল এসব গোনার টাইম নেই এদের। তোমরা যেসব জিনিসকে ইজ্জতের মনে কর, আমরা সেসব ছাই দিয়েও পুছি না।

গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে পাদ্রীরা সিদ্ধান্ত নিল, আমরা খলিফা উমারকে সরাসরি শহরের চাবি তুলে দিব। আমাদের আর্চবিশপ ফাদার সফ্রনিয়াস (Patriarch Sophronius) ওদের খলিফা উমারকে শহরের দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। জেরুজালেম-বিজয়ী সম্রাটের যে আলামতগুলো কিতাবে বলা আছে, সেগুলো মিলে গেলে তো আর তাকে খামোখা আটকিয়ে লাভ নেই। বেহুদা রক্তক্ষয় না করে ছেড়ে দেয়াই মঙ্গল। আর আলামত না মিললে দেখা যাবে তখন।

খলিফা উমার সিরিয়া হয়ে জেরুজালেম যাবেন। সিরিয়ান কমান্ডের প্রধান জেনারেল আবু উবাইদা ইবন জাররাহ রা. নিজ বাহিনীসহ এগিয়ে এলেন খলিফাকে প্রটোকল দেবার জন্য। এক তো উটে চড়ে এসেছেন, বাহন হিসেবে অনারবদের চোখে ‘বাইসাইকেল’ সমমর্যাদার। তাও আবার উটের উপরও তিনি নেই, লাগাম ধরে ধরে পানির স্রোত পেরোচ্ছেন। পরনে একটা চাদর, সফরের কারণে ধূলিমলিন। পায়ের মোজা খুলে কাঁধে নিয়েছেন, মাথায় পাগড়ী।

মুসলমানদের সম্রাটের এই দ্বীনহীন অবস্থা দেখে মুসলিমদের সম্পর্কে হেয় ধারণা করবে, এই আশঙ্কায় আবু উবাইদা রা. জিভ কেটে বললেন: আমীরুল মুমিনীন, এ কি করছেন? শহরের লোক দেখলে কী বলবে?

খলিফা জেনারেলের বুকে হাত মেরে জবাব দিলেন: ওহ আবু উবাইদা! যদি তুমি ছাড়া আর কেউ আজ এ কথা বলত, আমি তাকে এমন শাস্তি দিতাম, পুরো উম্মাত তা মনে রাখত। আমরা তো লাঞ্ছিত জাতি ছিলাম। আল্লাহ ইসলামের দ্বারা আমাদেরকে সম্মান দিয়েছেন। আজ সেই ইসলাম ছেড়ে অন্য কিছুতে সম্মান খুঁজতে গেলে আল্লাহ আবারও আমাদের লাঞ্ছিত করে দেবেন।

লোকেরা বললো: শামদেশের বিশিষ্টজনেরা আপনার সাক্ষাতের জন্য আসবে। আপনি যদি একটা তুর্কি ঘোড়ায় চড়তেন, তবে ভালো হোত।

খলিফা আবার জবাব দিলেন: তোমরা ভাবছো সম্মান এগুলো থেকে আসে? (দুনিয়ার বস্তু দ্বারা) কখনও না। বরং, সম্মান আসে ওখান থেকে (আকাশের দিকে ইশারা করে)। ছাড়ো আমার উটের পথ।

খলিফা রওয়ানা হলেন বাইতুল মুকাদ্দাসের পানে। উটে হাওদা নেই, জিন নেই, পা-দানি নেই। সাথে একমাত্র গোলাম আসলাম রহ.। একটা পশমী চাদর, ওটাই জিন, ওটাই বিছানা। একটা থলি আছে, ওটাই গদি, ওটাই বালিশ। লম্বা চেকের জামার এক পাশ ছিঁড়ে গেছে। জাবিয়া নগরে জেরুজালেম কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি হবে। সবাই সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষায়, সম্রাটের রাজকীয় প্রটোকল দেবার জন্য। তাও কি যে সে সম্রাট, খলিফা উমার ইবনে খাত্তাব রা.। দুইটা পরাশক্তিকে পরাজিতকারী পরাক্রমশালী সম্রাট। দূর থেকে কীসের যেন নড়াচড়া টের পাওয়া যায়। কিছু পরে বুঝা গেল, উটের পিঠে কেউ একজন আসছে। একটু পর বুঝা গেল একজন না, দু’জন। একজন উটের পিঠে, আরেকজন লাগাম ধরে সামনে সামনে। কাছে আসতেই দেখা গেল, উটের দড়ি ধরে আসছেন প্রায় ৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিক্রমশালী সম্রাট। আর উটের পিঠে গোলাম আসলাম রহ.। কী একটা অবস্থা দেখেন তো। আপনাদের ওসব শানশওকত, ভাবসাব, রাজকীয় ভংচং, প্রটোকলটল এসবের ধারই ধারি না, গুনিই না, টাইমই নাই।

- তোমাদের প্রধান কে?

- জি, ইনিই।

- ‘আমার জামাটা ছিঁড়ে গেছে একটু। সেলাইয়ের ব্যবস্থা করে দিন। আর ততোক্ষণ আমাকে একটা কাপড় ধার দিন।’ ১২৬৫ কিলোমিটার সফর করছেন এক কাপড়ে। তাও কতগুলো তালি। শখ করে? ঈকবা জুমআরর দিনে ঘর থেকে দেরিতে বেরোলেন। কারণ দর্শালেন: একমাত্র জামাটা শুকোতে দেরি হচ্ছিল, তাই। [4]

জামা খুলে দিলেন, চমকদার নতুন একটা জামা দেয়া হল। কি কাপড় এটা? কাতান। কাতান কী কাপড়? তাঁকে বুঝানো হল কাতান কেমন কাপড়। ও, কাতানের কথা আসতেই আরেকটা কাহিনী মনে পড়ে গেল। আবু হুরাইরা রা. তখন বাহরাইনের গভর্নর। কাতানের কাপড় দিয়ে নাক সাফ করছেন আর আনমনে বলছেন: হে আবু হুরাইরা, নিজের দিকে চেয়ে দেখ। ক্ষুধার জ্বালায় পড়ে থাকতে, মানুষ মৃগীরোগী ভেবে গলা পাড়াতো। আজ কাতানের কাপড় দিয়ে নাক সাফ করছো। দুনিয়ার চাকচিক্য দেখার-বুঝার-শেখার টাইম নাই, বস।

তো উমার রা. সেই কাতানের জামাটা পরলেন মাথা গলিয়ে। খানিক বাদে তালি লাগিয়ে ধুয়ে আগের কাপড়টা আনা হল। দামি কাপড় ফেরত দিয়ে নিজের শতচ্ছিন্ন কোর্তাই আবার পরে নিলেন। আর্চবিশপ বললেন:

- আপনি আরবদের বাদশাহ। আমাদের এলাকায় উটে চড়াকে ভালো বলে না। আপনার এই পোশাকও মানায় না। আপনি যদি ভালো একটা জামা পরতেন, আর একটা তুর্কি ঘোড়ায় চড়তেন, তবে রোমানদের চোখে আপনার সম্মান বাড়ত।

আমাদের সম্মান দেয়া হয়েছে ইসলাম দ্বারা। সম্মানের জন্য আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কিছুকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।

তোমাদের দেয়া সম্মান, তোমাদের চোখে বড় হওয়া, তোমাদের কাছ ভালো হওয়ার কানাকড়ি পরিমাণ মূল্য আমার কাছে নেই। হায় হায়! আমরা নাকি এঁদের উত্তরসূরি? কাফিরদের কাছে উন্নত হওয়া, কাফিরদের চোখে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া, তাদের কাছে অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য, তাদের দেয়া টার্গেট-গোল পূরণ করে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আজ আমরা কত ব্যাকুল। আল্লাহর হুকুমের তোয়াক্কা নেই, নবীর সুন্নাহর পরোয়া নেই। শরীয়া আর শরীয়ার ধারকেরা আমাদের কাছে অপাংক্তেয়। যতদিন আমরা ড্যামকেয়ার ছিলাম, সবাই আমাদের কেয়ার করে চলেছে। আজ সবাইকে কেয়ার করতে গিয়ে নিজেরা খেলো হয়ে গেছি। আহ! সেইদিনগুলো!

উমার রা. এর খিলাফত, সাহাবারা তখন পারস্য সাম্রাজ্যের ভিতরে। ব্যাপারটা এমন, ধরে নেন বাংলাদেশ চীনের সাথে বা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করছে। পারস্য সাম্রাজ্যের ডাকসাইটে আর্মি চীফ জেনারেল রুস্তমের নামডাক তখন দুনিয়াজোড়া। পুবে চীন, পশ্চিমে ইউরোপ সবাই একনামে চেনে। গণক বলে গেছে এই যুদ্ধে রুস্তম হারবে, তাই যেকোন মূল্যে বাংলাদেশের সাথে সন্ধির রাস্তা খুঁজছে চীন কিম্বা রাশিয়া। পার্টিক্স দেখছেন? শান্তি আলোচনার প্রস্তাব পেয়ে মুসলিম শিবিরে একাংশকে নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকলেন মুসলিম বাহিনীর প্রধান সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা.। সাহাবাদের বাতচিতগুলি খুব খেয়াল করার বিষয় আছে, এমনি কথোপকথনের মত পড়ে যাবেন না। প্রতিটা ডায়ালগ খুব ভাববেন।

সাদ: তোমাদেরকে রুস্তমের কাছে পাঠাতে চাচ্ছি, কী বলো?

সবাই: আপনার যেকোন কমান্ড আমরা হুবহু ফলো করবো এবং মিশন একমপ্লিশ করে আসবো। আর কোনো বিষয়ে আপনার দিকনির্দেশনা না থাকলে আমাদের যেটাতে কল্যাণ তেমন কিছু একটা বলে আসবো।

সাদ: তবে তোমরা সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নাও।

রিবঈ: অনারব লোকেদের নিজস্ব নিয়ম পদ্ধতি ও আদব কায়দা আছে। আমরা এতো লোক একসাথে তাদের নিকট গেলে তারা মনে করবে আমরা তাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি। অতএব আপনি তাদের কাছে একজনের বেশি পাঠাবেন না।

সবাই: রিবঈ ঠিকই বলেছে।

রিবঈ: আপনাদের পক্ষ থেকে আমি যাবার জন্য তৈরি আছি। আমাকে পাঠাতে পারেন।

সাদ: ঠিক আছে। তাহলে রিবঈ, তুমিই যাও।

রিবঈ ইবনে আমের রা. প্রস্তুতি নিলেন। ঝাঁকড়া চুলে চারটি ঝুঁটি করলেন। ছালার চট মাঝ থেকে ছিঁড়ে জামা বানালেন, দড়ি দিয়ে কোমরবন্ধ বানালেন। উটের চামড়ার লাগাম দিয়ে পাগড়ি পরলেন। তার উপর বর্ম। সাথে নিলেন গরুর চামড়ার ঢাল, বর্শা, নেকড়ায় পেঁচানো তরবারি, তীর-ধনুক।

ওদিকে রুস্তমের ক্যান্টনমেন্টে জাঁদরেল অফিসারদের নিয়ে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হল, আমরা আরবদেরকে আমাদের সেনাসংখ্যা ও সামরিক শক্তির ভয় তো দেখাবোই। সাথে সাথে আমাদের জাঁকজমক ও শানশওকত দেখিয়ে ওদেরকে প্রভাবিত করবো, দেখাব যে আমাদের তুলনায় তোমরা কত তুচ্ছ। সেই মোতাবেক রুস্তমের সোনার সিংহাসন, মূল্যবান কাপড়ের সজ্জা, দামী দামী গালিচা, সোনার সুতো দিয়ে বুনানো বালিশ এগুলো দিয়ে দরবার হল সাজানো হল খুব করে।

রিবঈ রা. দামী গালিচার উপরে ঘোড়া পুরোটা উঠিয়ে দিলেন। [ক]

সোনায় বুনা দুটি বালিশ ছিঁড়ে তার সাথে ঘোড়া বাঁধলেন। [খ]

যখন তাকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে রেখে ভিতরে যেতে বলা হল, তিনি বললেন: আমি তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজনে আসিনি। তোমরাই আমাকে ডেকেছো। আমার মনমতো যদি আসতে দাও তাহলে আসবো, নাহলে এখান থেকেই ফিরে চলে যাচ্ছি। [গ]

গালিচার উপর দিয়ে বর্শার ফাল গেঁথে গেঁথে ছোট কদমে যেতে লাগলেন। দামী গালিচা ও বিছানা ছিদ্র করে নষ্ট করে দিলেন। [ঘ] এরপর একদম কাছে গিয়ে বিছানার উপর বর্শা গেঁথে নিজে মাটির উপর বসলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানালেন: আমি তোমাদের সাজসজ্জার জিনিসের উপর বসবো না। [ঙ]

ক, খ, গ, ঘ, ঙ— উনি কেন করলেন? তিনি ইচ্ছা করেই এমনটা করেছিলেন, যাতে পারস্যবাসীরা বুঝে নেয় যে, তাদের এসব শাহী চাকচিক্য দ্বারা তিনি একটুও প্রভাবিত নন। তাদের দুনিয়ার এসব নাজ-নেয়ামত গোনায় ধরার সময় নেই ওনার।

ঠাণ্ডা গলায় রিবঈ রা. বলেন: হে পারস্যবাসী, তোমরা খাওয়া, পান করা ও লেবাস-পোশাককে বড় জিনিস মনে কর, আর আমরা উহাকে নগণ্য জিনিস মনে করি, গোনায়ই ধরি না।

রুস্তম এবার মুখ খুলল: আপনারা আরব থেকে কেন এসেছেন, কী চান?

সাফসুতরা নির্বিকার জবাব: আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। তিনি এজন্য আমাদেরকে পাঠিয়েছেন যাতে আমরা তাঁর ইচ্ছায় তাঁর বান্দাদেরকে ‘বান্দার বন্দেগী থেকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে’, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে, সমস্ত বাতিল ধর্মের জুলুম থেকে দ্বীনে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে আসি। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের দিকে ডাকার জন্য নিজ সৃষ্টির কাছে পাঠিয়েছেন। যে ডাকে সাড়া দিবে তাকে আমরা মেনে নিব এবং চলে যাব। যে মেনে নিবে না, তার সাথে আমরা যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আল্লাহর ওয়াদা পুরা হয়।

রুস্তম: কী আল্লাহর ওয়াদা?

রিবঈ: আল্লাহর ওয়াদা হল, ইসলাম অস্বীকারকারীদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে মৃত্যুবরণ করবে তার জন্য বেহেশত। আর যে বেঁচে থাকবে তার জন্য বিজয় ও সফলতা।

রুস্তম: আপনারা কি আমাদের কিছু সময় দিতে রাজি আছেন, যাতে আমরা একটু চিন্তা করে দেখতে পারি? এই পরিমাণ সময় যাতে আমাদের নেতৃস্থানীয়দের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে পরামর্শ করতে পারি।

রিবঈ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বাতলে দিয়েছেন যে আমরা যেন যুদ্ধে মুখোমুখি হবার পর শত্রুকে ৩ দিনের বেশি সময় না দিই। অতএব তোমাদেরকে ৩ দিন সময় দিলাম।

কী একটা অবস্থা দেখেন, বাংলাদেশ রাশিয়াকে বা চীনকে বা আমেরিকাকে ৩ দিন সময় দিচ্ছে।

হাল আমলের ঘটনা। মস্কোতে ‘আফগান শান্তি আলোচনা’য় তালেবান প্রতিনিধিকে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল:

- অস্ত্রবিরতি কবে হবে?

- আমেরিকা সৈন্য প্রত্যাহার করলে।

- যদি না করে, তাহলে?

- ‘তাহলে আর কি? যুদ্ধ চলবে’, ঠাণ্ডা ও নির্বিকার জবাব। আধুনিক অস্ত্র নেই, ড্রোন নেই, অ্যাটম বোম নেই। বলছে, আমেরিকার সাথে যুদ্ধ চলবে। যেন বললো, শোনো ম্যারিকা ব্রো, তোমার ওসব গোনার সময় আমাদের নাই। ওসব মাখলুক। আর আমরা খালিকের লোক। মাখলুক-টাখলুক গুনি না।

হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. এর বাহিনী যখন প্রমত্তা দজলার জোয়ারে দ্বিধাগ্রস্ত, কীভাবে ওপারে পৌঁছানো যায়। হাজার ইবনে আদী রহঃ বললেন: নদী পার হয়ে শত্রু পর্যন্ত পৌঁছতে শুধু এই পানির কাতরা (বিন্দু) তোমাদেরকে বাধা দিচ্ছে? অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘কারও মৃত্যু আসা সম্ভব নয় আল্লাহর আদেশ ব্যতীত, আর তা এইভাবে যে, মৃত্যুর জন্য নির্দিষ্ট সময় লেখা থাকে।’ এরপর তিনি ঘোড়া নামিয়ে দিলেন। এতবড় একটা নদীকে গোণায় ধরলেনই না। যুবায়ের ইবনে আওয়াম রা. খালি গায়ে শত্রুদের মাঝে ঢুকতেন দুই তলোয়ার নিয়ে, একপাশ থেকে ঢুকতেন, আরেক পাশ দিয়ে বেরোতেন, এভাবে আবার, বার বার। আর বলতেন: ‘আজ যদি মৃত্যু লেখাই থাকে তাহলে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আর যদি লেখা নাই থাকে তাহলে কারো ক্ষমতা নেই আমাকে মারার।’ ঈমানওয়ালা তাকদীরে ঈমান রাখে, অহেতুক ভয় করার সময় নেই।

দুনিয়া মুমিনের কারাগার, আর কাফিরের জান্নাত। দুনিয়ার জীবনই গুনি না, তোমাদের জান্নাত তোমরা কেয়ার করগে। আমরা দুনিয়াদারি কেয়ার করি না, এখানে কী পেলাম না পেলাম ওসব হিসেব করার সময় নেই। বাঁচলে লাভ, মরলে আরও বড় লাভ। এক সাহাবীকে এক কাফির কতল করে দিয়েছে, আর কোপ খেয়ে সাহাবী বলে উঠেছেন: ‘কাবার রব্বের কসম, আমি তো সফল হয়ে গেছি।’ বাঁচলে সই, মরলে আরও বড় সফলতা। মৃত্যু তো মুমিনের জন্য কারাগার থেকে মুক্তির মত, দুনিয়া আমাদের কারাগার। মৃত্যু, সে তো জীবনের চেয়েও আপন। আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. ৩ দিন কিছু খান না। ৩ দিন পর দুই-তিনটা খেজুর মিলেছে খাওয়ার মত। খাওয়া শুরু করতেই ওদিকে যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। খেতে খেতে বলছেন: ‘এই খেজুরগুলো শেষ করা অব্দি যদি অপেক্ষা করতে হয়, তবে সেটা তো দীর্ঘ জীবন হয়ে গেল।’ খেজুর ফেলে তরবারি তুলে নিলেন, এরপর শহীদ হয়ে গেলেন। মৃত্যু আকাঙ্ক্ষিত, মৃত্যু তাদের আগ্রহের জিনিস, মৃত্যুর অপর নাম ভালোবাসা। খালিদ রা. বলছেন পারস্য সাম্রাজ্যের হীরা শহরের গভর্নরকে: কাবীসা, ইসলাম কবুল করলে আমরা আর তোমরা সমান। নয়তো জিযিয়া দিতে হবে। আর জিযিয়াও দিতে অস্বীকার করলে শোনো, আমার সাথে এমন এক আর্মি আছে যারা মৃত্যুকে ভালোবাসে; তোমরা যেমন জীবনকে ভালোবাসো তার চেয়েও বেশি তারা মৃত্যুকে ভালোবাসে। অস্থির ব্যাপারস্যাপার। জীবন-টীবন থোড়াই কেয়ার।

কী ভাবের দিনই না ছিল বাহে, যতদিন ইসলাম ছিল। কাউকে, কোনো কিছুকে গোনার টাইম ছিল না। এহন সবাইরে গুনতে গিয়া আমগোরেই কেউ গণায় ধরে না। দাও ফিরিয়ে সে ড্যামকেয়ার, দাও ফিরিয়ে সেই দ্বীনে ইসলাম, লও এই ওয়াহান— দুনিয়ার ভালোবাসা আর মরণের ভয়।


[1] আখবারু উমার, পৃ ৩৩২ সূত্রে উমার রাসম্পর্কে ১৫০ টি শিক্ষণীয় ঘটনা, পীস পাবলিকেশান।
[2] ইমাম আহমদের কিতাবুয যুহদ সূত্রে ড. আলি সাল্লাবি, পৃ. ১/২৭২, কালান্তর প্রকাশনী
[3] তাবাকাতুল কুবরার বিশুদ্ধ সূত্রে আলি সাল্লাবি, প্রাগুক্ত।
[4] ড. সাল্লাবি ১/২৭৩