শৈশবে মা-বাবা শেখালেন ফিরোজের চেয়ে ভাল রেজাল্ট করতে হবে, হাতের লেখা মামুনের লেখার চেয়ে সুন্দর হতে হবে, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, ডিবেট… সব ক'টা ইভেন্টে সবার চেয়ে সেরা হতে হবে।

স্কুলের শিক্ষকরাও শেখালেন বসে থাকার নাম হেরে যাওয়া। অতএব দৌড়াও। লেকচার, হোমওয়ার্ক, প্রাইভেটে পড়ো, ভালো নোট, সাজেশন সংগ্রহ করে ঝাঁপিয়ে পড়ো পরীক্ষার খাতায়।

ওদিকে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, মগজ-মনন তখন একটু-একটু করে দখল করে নিচ্ছে বয়োঃসন্ধির কৌতূহল। ছোটদের জন্য যা নিষিদ্ধ তার সবটাতেই এক অজানা হাতছানি, অমোঘ আকর্ষণ, শিহরিত ভালো লাগা.., অতঃপর নফসের কাছে ক্রমান্বয়ে আত্মসমর্পনের পালা। প্রতিযোগিতার পরিধি তখন আর বইয়ের পাতায় বসে নেই। স্টাইল, ফ্যাশন, কায়দা-কানুনে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা…, নইলে সুমনা, মাহবুবা, হুসনাদেরকে বাপ্পী-হীরারা ইম্প্রেস করে ফেলবে যে!

বন্ধুদের আড্ডায় সবচেয়ে 'কুল' হতে চাওয়া, রাজনীতিতে বাকপটু আর কূটচালে সবার কাছ থেকে 'ওয়াও' পাবার আশায় কত চেষ্টা, কত অপচয়!

তারপর বাস্তবতার ঠ্যালা গায়ে লাগা শুরু হলে ক্যারিয়ারের পিছনে ছোটার দৌড়। অমুক মেডিকেলে চ্যান্স পেয়েছে, তমুক ঢুকেছে সেনাবাহিনীতে, সমুক গেছে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায় স্টাডি করতে। অতএব দৌড়াও। একটা কিছু করো যাতে তুমিও বুক চিতিয়ে হাঁটতে পারো।

অতঃপর জীবনের প্রতিযোগিতার আরেক নতুন ডাইমেনশন শুরু হয় নিজের সংসারে ঢুকে। আর দশজন হাজব্যান্ডের চেয়ে ভালো অথবা নিদেনপক্ষে সমমানের লাক্সারি, স্টেইটাস, হলিডেইজ, শপিং আর ব্র্যাগিংয়ের প্রতিযোগিতা। অমুকের ছেলে-মেয়েরা ফার্স্ট-সেকেন্ড হচ্ছে, অতএব লাগাও ধাক্কা নিজেরগুলোকে!

এভাবে হাজারটা কম্পিটিশনে জড়িয়ে থাকি জীবনভর। একেক সময় আসে একেক প্রতিদ্বন্দ্বী। এর কোন শেষ নেই, কোন ফাইনাল রেজাল্টও নেই। যখনই একজন শীর্ষে দাঁড়িয়ে বিজয়ের হাসি দেয়, তোলে তৃপ্তির ঢেঁকুর…., ঐ অতটুকু অবসরেই আরেকজন তাকে ছাড়িয়ে চলে যায় আরো বহুদূর।

বিল গেটস, কার্লোস স্লিম, ওয়ারেন বাফেট, স্টীভ জবসরাও প্রতিযোগিতা করেছে। প্রতিনিয়ত ওঠানামা করেছে তাদের সূচক। স্টীভ আর খেলবে না কোনদিন। অন্যদেরও সময় ফুরাবে। কী হলো রেজাল্ট?

আপনার সাথে আমি অথবা আমার সাথে আপনি কোন প্রতিযোগিতায় জিতলে-হারলে তেমন কিছুই যায়-আসে না ভাই। এর ফলাফল খুবই স্বল্পসময়ের উচ্ছ্বাস নয় গ্লানি। আমি এমন এক প্রতিযোগিতার কথা বলতে চাচ্ছি যার ফলাফল চিরস্থায়ী জান্নাত অথবা জাহান্নাম। এই ইভেন্টে আপনার আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী খোদ শয়তান।

দুনিয়ার কোন কম্পিটিশনে এত অভিজ্ঞ, চৌকস, ধৈর্যশীল, ফোকাসড, ইনফ্লুয়েনশিয়াল আর পাওয়ারফুল প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা পাইনি। আমাদের রাইভালরা মরে যায়, নইলে অন্য কোথাও হারিয়ে যায়, অথবা সেই গেইম যায় ওভার হয়ে। অন্যদিকে শয়তানের আয়ু কিয়ামত অবধি। তার জীবনে অন্য কোন টার্গেট নাই আমাকে জাহান্নামে নেয়া ছাড়া। তার ধৈর্য ধরে লেগে থাকার অসীম ক্ষমতা।

আমরা সারাদিনের নানান ব্যস্ততা, আনন্দ-হাসি-তামাশা, জীবন ও যৌবন উপভোগে মত্ত থাকি। শয়তান ঘুমায় না। অতন্দ্র তপস্যারত সারাটা ক্ষণ তার একটাই টার্গেট-আমাকে আর আপনাকে জাহান্নামি করা।

অমুক ভাইয়ের আইফোন সেভেন আছে দেখে আফসোস করার সময় আর মানসিকতা কোত্থেকে আসে রে ভাই?

পাড়ার ছ্যাঁচড়া মাস্তানে একটা হুমকি দিলে রাতের ঘুম উধাও হয়ে যায়…. আর শয়তানের মত এত বড় শত্রুকে বুকের ভিতরে বাসা বাঁধতে দিয়েও কত নিশ্চিন্ত আমরা!

সবচেয়ে বড় আইরনি হচ্ছে-দৃশ্যমান কেউ কোনদিক দিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেলে আমাদের খুব গায়ে লাগে, তাকে হিংসা হয়, দেখতে পারি না। অথচ সবচেয়ে বড় শত্রু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে জেনেও তার ক্ষতিগুলোকে শুধু মেনেই নিই না, উপভোগও করি!!