তিনি মারা গেলেন সকাল আটটায়.....

আগের রাতে শেরাটনে 'ধর্মীয় গোঁড়ামি অপসারণে মুক্তচিন্তার ভূমিকা' শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রেখেছিলেন। বলেছিলেন, এদেশে উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা ইসলাম। কাঠমোল্লাদের জন্যই দেশ আজো কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। অনেক বছর আগেই আমি ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সরে এসেছি।

সকাল নটায় তাকে পাওয়া গেলো তার বেডরুমে, মৃত। ১০ টার খবরে প্রচার হলো তার মৃত্যুসংবাদ। সাড়া পড়ে গেলো বামপাড়া ও রামপাড়ায়।


তার ইস্কাটনের বাসায় এলেন বুদ্ধিজীবীরা। ড্রয়িংরুমে বড় করে বাঁধানো তার হাস্যোজ্জ্বল ছবির নিচে বসে সাক্ষাতকার দিলেন তারা। তারা জানালেন, দেশ আজ আপোষহীন এক মুক্তমনা যোদ্ধাকে হারিয়েছে। চুরুট টানতে টানতে একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক বললেন, তিনি ধর্ম ও ধার্মিকতার সকল কুসংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। দেশের উন্নতির জন্য আমাদেরও সে পথে হাঁটতে হবে। করতালিতে চাপা পড়ে গেল অধ্যাপকের কথা, সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্লাশ প্রতিফলিত হলো তার মোটা ফ্রেমের চশমায়।

তার মৃত্যুতে শোকাহত হলেন অনেকেই, ইউরোপ থেকে দুজন ব্লগার টুইটারে শোকবার্তা লিখলেন। কলকাতার বুদ্ধিজীবিরাও সাক্ষাতকার দিতে ছুটলেন আনন্দবাজারের অফিসে।

ঘুরে ফিরে একই কথা বললেন সবাই, তিনি ছিলেন এক জ্ঞানসাধক। জ্ঞানের রাজ্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ।

দুষ্টলোকরা অবশ্য উসকানি দিয়ে বললো, যে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সে তার রবকে চিনতে পারেনি, সেই জ্ঞান কোনো জ্ঞানই নয়।


গোসল ও কাফন পরানো শেষে লাশ নিয়ে আসা হলো শহীদ মিনারে। ফুল দিয়ে কফিনকে বরণ করে নিল সবাই। সবকটা চ্যানেলে একযোগে দেখালো সে দৃশ্য।

শহীদ মিনারে রাখা তার লাশের কফিন। শরীরে সাদা কাফন পড়ানো। বুদ্ধিজীবীরা ফুল দিয়ে গেল। কেউ কোনো প্রতিবাদ জানালো না। কেউ বললো না, খুলে ফেলো কাফনের কাপড়, কারণ 'অসাম্প্রদায়িক' শরীরে 'সাম্প্রদায়িক' পোষাক মানায় না।

জানাজা হলো শেষ বিকেলে। সরকারি মসজিদের এক ইমাম চাকরি বাঁচাতে জানাজা পড়াতে রাজি হলেন। বেচারার মুখটা ছিল ফ্যাকাশে, বাধ্য না হলে হয়তো কাজটা করতো না সে।

জানাজায় যারা এলো, কারোই অজু ছিলো না। দুয়েকজন অবশ্য সতর্কতা হিসেবে দুই হাত পানিতে চুবিয়ে নিল। পেছনের কাতারে দুয়েকজন হিন্দু দাদাও ছিল। সর্বধর্ম বলে একটা কথা আছে কত্তা, এই বলে হে হে করে হাসলেন তারা। জানাজার দৃশ্যটা অদ্ভুত দেখালো, কেউ কেউ ডান হাতের উপর বাম হাত বেধে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন আসমানের দিকে, কেউ লাইভ প্রচার করা ক্যামেরাগুলোর দিকে, বুদ্ধিমানরা অত ঝামেলায় গেলেন না, দু’হাত খুলে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনেই ব্যস্ত হলেন।

জানাজা শেষে, লাশ এলো বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে। জীবনে যাদের সাথে ছিলেন, মরণেও তাদের সাথে রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে এখানে। দুষ্টলোকরা অবশ্য বলে, আজাবের ফেরেশতার সুবিধা হয় এতে। পালের গোদা সবগুলোকে একসাথে পাওয়া যায় এখানে।


মাটিতে নামানো হলো লাশ। সম্মান দেখিয়ে একুশবার ফাঁকা গুলির শব্দ করা হলো। ভয়ে পেয়ে দুটো ঘুঘো গাছের ডাল ছেড়ে উড়াল দিলো। কেউ একজন অশুদ্ধ উচ্চারণে পড়লেন, বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ। এভাবে মৃত ব্যক্তিটির সাথে চরম গাদ্দারি করলো তার জীবিত বন্ধুরা।

লাশ রাখা শেষে মাটি চাপা দেয়া হল।

সারা জীবন কটাক্ষ করেছেন ধর্মকে, শত্রু ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষার। ভালো লাগেনি মদীনার নবীর কথা। কিন্তু এখন, মদীনার নবীর শেখানো পদ্ধতিতে, যাত্রা করলেন অসীম অনন্তে। অবাক করা ব্যাপার হলো, তার বন্ধু ও সহকর্মীদের মনেও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন দেখা দিল না। তারাও ধরে নিয়েছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু।


সেদিন সন্ধ্যায় তার বিলাসবহুল বাড়ির সামনে জ্বালানো হলো ৮৪ টি মোমবাতি।

৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন একথা বুঝাতে। দুষ্টলোকরা অবশ্য বললো, ‘কবরে আগুন জ্বলছে, তাই বারান্দায় ঝোলানো তার ছবির নিচেও মোমবাতির আগুন।’


একথা শুনে সদ্য করোনা থেকে ফিরে আসা এক অধ্যাপক বিরস বদনে বললেন, হুহ, একদিন সবকিছু নষ্টদের দখলে যাবে।

(লেখাটা ২০১১ সালে লেখা, এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। বিশেষ বিশেষ দিনে এখনো লেখাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে)

:)