এক

ফজরের সলাতে নিজেকে মাসজিদের কাতারে দাঁড়া করাস না তুই। জায়নামাজে দাঁড়া করাস না তোর আদরের ঘুমকাতুরে শরীরটাকে। ইচ্ছে করেই করস না। অথচ তোর হাতেই কিনা দেয়া হইসে উম্মাহর ঝান্ডা! সহস্র মা-বোনের ইজ্জত আর বাপ-ভাইয়ের রক্ত ঝরা বৃষ্টি তোর চোয়ালকে শক্ত করে না। চোখ ভিজায় না।

তোর মতো স্পাইনলেসকে আমি কোনদিন কোন বিধবা বোনের দায়িত্ব নিতে বলি নাই, কোন এতীম শিশুর দায়িত্ব নিতেও বলি নাই। বলবোও না। কারণ, তোর সেই “হেডাম” নাই। কারণ, পশ্চিমা খামারে থাকা শুয়োরগুলোর মতো তুইও বেঁচে থাকস তোর আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে। তোর সাথে একটা দাঁতওয়ালা জানোয়ারের এগজ্যাক্ট ডিফারেন্সটা আসলে কোথায়? জানোস? জানস না। জানলেতো আলাদাই হইতি।

তুই মানুষ। হ্যাঁ, তোকে বলতেসি। তুই মানুষ। এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে তোর মাথা নীচু করার কথা না। সৃষ্টির পরপরই এই মানুষের সামনে ফেরেশতাসহ জ্বীনকে সিজদার আদেশ দিসিলেন সবকিছুর স্রষ্টা।

কেন?

ভাল করে খেয়াল কর এখানে। মানুষের দেহ সৃষ্টির পরে সিজদা করতে বলেন নাই কিন্তু উনি। সেই দেহে রুহ ফুঁকে দেয়ার পরে সিজদা করতে বলসেন।

কেন?

তুই কি বুঝতেসোস না যে তুই এই দেহের বাইরের অসাধারণ এক সত্তা? তুই এই নশ্বর দেহের অসাধারণ এক চালক। তুইতো এই দেহের দাস না। তুইতো এর বাইরে। মুক্ত। তোর দেহকে শিকল পরানো যাবে, টর্চার করা যাবে, বাট তোর উপরেতো এক আল্লাহ ছাড়া লিট্যারেলি কারো কোন ক্ষমতা নাই। উনি বাদে কেউ কিচ্ছু করতারবে না তোর। কোন জ্বীন না, মানুষ না, ফেরেশতাও না। কক্ষণো না। এইটা তুই কবে বুঝবি? কবে চিনবি নিজেকে, হ্যাঁ? তুইতো এই দেহের সৃষ্ট চাওয়া-পাওয়ার দাস না, গোলাম না। তাও খালি দেহের, আরামের গোলামী করস।

কেন?

তুই কবে বুঝবি তোর অসাধারণ সত্তাটা তোর আজ্ঞাবহ এই দেহকে দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত, এমনকি ভোররাতেও একমাত্র মালিকের সামনে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে পারার কথা উনার আদেশে? এর সবচাইতে অহংকারী অংশ মাথাকে তার তৈরি করা মন, যুক্তির গর্ব সহ ওই একমাত্র প্রভুর সামনে মাটিতে লুটিয়ে দেয়ার কথা? তোর শ্রেষ্ঠত্ব এতেই। তোর মানুষ হয়ে ওঠার এটা প্রথম ধাপ। আর এতেই কিনা তুই ডাব্বা মারতেসস? তোকে দেয়া শরীর আর মনের উপরে পূর্ণ দখল এনে একে তোর রাব্বের সন্তুষ্টির দিকে ব্যবহারই যদি করাইতে না পারলি, তাইলে তুই আর কিসের মানুষ? তুইতো শরীরকেন্দ্রিক একটা জানোয়ার ছাড়া আর বেশি কিছু না। তুইতো তোর ম্যাটেরিয়ালিস্টিক শরীরের দাস। ভোগ ছাড়া কিছুই বুঝস না তুই। ভোগ-উপভোগই তোর মালিক। দাজ্জালের দেখানো আরাম-আয়েশ-জান্নাতই তোর জিন্দেগীর মাকসাদ। তুইতো নিজেকে দাজ্জালের শ্রেষ্ঠ জানবাজ ফ্যান হিসেবে গড়ে তুলতেসোস। যদিও তোর মতো আজাইরাকে দাজ্জালও গুণবে কিনা সন্দেহ!

তোর পরিবার, বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে ফজরের সলাতে দাঁড়া। পাঁচ ওয়াক্ত ঠিক হয়ে যাবে। এইটুকু ঠিক না করতে পারলে তুই উম্মাহর আর কী কাজে আসবি? নিজেকেই বাঁচাইতে কেমনে হয় বুঝতেসস না, সেই তুই অন্যকে কিভাবে সার্ভ করবি?

এই ওয়াক্তেই গোসল করে, তাওবা করে ঠিক হ। এখুনই ঠিক হ। তাওবা কর। ফিরে আয়।

অন্যকেও জানা।

আর যেন কক্ষনো, কোনওদিন ভুলেও ফজর মিস করবার মতো দুঃসাহস না হয় তোর।

দুই

{বুকের ভেতরটা কেবলই ইসলামকে নিজের জিন্দেগীতে মেনে নিয়ে মুক্ত স্বাধীন হয়ে উঠতে চায়? তাহলে এই লেখাটা সেই অদম্য সাহসী হয়ে উঠতে চাওয়া, শক্তিশালী হৃদয়ের আপনাকেই উৎসর্গ করলাম।}

একটা ছেলে যখন ভালোভাবেই জানে যে, তার চারপাশের মানুষগুলো কেউ এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিবে না, প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করবে, নানান বিশ্রী আর কুৎসিত নামে ডাকবে, অনেক হ্যাপা পোহাতে হবে, তারপরেও সে শুধুমাত্র রাসুল (সাঃ) “আদেশ” করেছেন বলে, কেটে ফেলা “নিষিদ্ধ” বলে, সমস্ত সমাজের প্রায় সব মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দাড়ি রাখা শুরু করে, তখন স্পিরিচুয়ালি সে একধাপ উপরে উঠে যায়। সে শিখে যায়, কীভাবে বেশি মানুষের কথাকে পাত্তা না দিয়ে জমাট কনক্রিটের দেয়ালের মতো দাঁড়াতে হয় শুধুমাত্র নিজের আল্লাহ আর প্রাণপ্রিয় রাসুলের (সাঃ) সন্তুষ্টির জন্যে।

একটা মেয়ে যখন ভালোভাবেই জানে, সামনে কী ভয়ংকর দূর্বিষহ পথ, সবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি কীভাবে তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে, বাক্যের বিষবাণে তার অন্তরটাকে টকটকে রক্তে জবজবে ভিজিয়ে, ডুবিয়ে তবেই ছাড়বে, তারপরেও সে শুধুমাত্র নিজের আল্লাহ আর প্রাণপ্রিয় রাসুলের (সাঃ) সন্তুষ্টির জন্যে উনার দেখানো নিয়মানুযায়ীই (শুধুমাত্র পোশাকেই নয়, ব্যবহারেও) নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে অপ্রকাশিত রাখতে শিখে, নিজের কথাবার্তা আর আচার ব্যবহারকে ব্যক্তিত্বময় করে নিতে শিখে, তখন সেও স্পিরিচুয়ালি গ্রানাইট পাথরের মতো নিজের আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের (সাঃ) সন্তুষ্টির জন্যে দাঁড়ানোর শক্তিটা পেয়ে যায়। শিখে যায়, সমাজের অধিকাংশের মতের নষ্টতার বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়াতে হয় সত্যের পক্ষে। নিজের অধিকারের পক্ষে।

একটা ছেলে বা মেয়ে যখন পর্দা মেইনটেইনের মাধ্যমে শুধুমাত্র আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের (সাঃ) সন্তুষ্টির জন্যেই বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুদের সাথে মেলামেশা তো দূরে থাকুক, বরং নন-মাহরাম আত্মীয়-স্বজন, যেমন ভাবী, দুলাভাই বা কাজিনদের সাথেও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বাদ দিয়ে দেয়, চোখকে সংযত করে চলার চেষ্টা করে, তখন সর্বপ্রথম সে বুঝতে শুরু করে, “সমাজ কাকে বলে? সমাজ কত প্রকার ও কীকী? প্রত্যেক প্রকারের উদাহরণসহ সংজ্ঞা…”

আমাদের প্রিয়তম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে এসবের মধ্য দিয়ে কেবলই শিখিয়ে যান, আমাদের মানসিক শক্তিকে বাড়াতেই থাকেন আর প্রস্তুত করেন। আমরা বুকের ভেতরে সর্বপ্রথম রাসুলের (সাঃ) জন্যে ভালোবাসার অসম্ভব সুন্দর তীব্রতাটাকে অনুভব করি। আল্লাহর নিজের বলা নিচের কথাগুলোকে সর্বপ্রথম বুকের গভীরে গেঁথে যেতে দেখিঃ

“…Do not grieve; indeed Allah is with us…”
[Al-Quran: 9: 40]

“O you, who have believed, seek help through patience and prayer.
Indeed, Allah is with the patient.”
[Al-Quran: 2: 153]

আল্লাহ বলে দিয়েছেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চিতভাবেই তিনি ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন।
আল্লাহ সাথে আছেন, তো আমাদের আর কী লাগে?
আল্লাহ তোমাকে অজস্র থ্যাঙ্কস। তুমি বেশি বেশি বেশশশি অসাম!
আলহামদুলিল্লাহ!

ও আল্লাহ, আমাদের সবাইকেই বুঝার শক্তি দাও, তোমার পথে পরিপূর্ণভাবে আসার তৌফিক দাও। আ-মীন।

তিন

আপনি একটা মানুষ যার মাথার ভিতরে একটা ব্রেইন দেয়া হইসে। সেই আপনি ইসলামের সত্যতা জানসেন। জানার পরেও আপনি খালি ইসলাম বিদ্বেষীদের লেখা পড়েন, তাদের ব্লগে ঘুরেন, তাদের লেখা বই-প্রবন্ধ পড়েন, ইসলাম খুঁজেন ওই আস্তাকুঁড়ে।

ভাই, ও ভাই, আপনি ইসলামকে জানসেন আগে? পুরোটা কুর’আন অন্তত একবার বুঝে পড়সেন আগাগোড়া? পড়েন নাই। কুর’আন পড়ার সময় অনেক জায়গায় অনেক প্রশ্ন মাথায় আসে। কুর’আন যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর জ্ঞানের অসীমতার কারণে এমন প্রশ্ন আসবেই। তো, সেগুলো কোন ভাল স্কলারের কাছে বসে ক্লিয়ার করতেসেন? শিখতেসেন? ভাবতেসেন? নিজেকে আবিষ্কার করতেসেন গোড়া থেকে? স্কলারের কাছে অন্তত একটা হাদীসের বই শেষ করসেন বুঝে বুঝে? অন্তত একটা?

করেন নাই।

ক্লাস ওয়ান, টু শেষ করেন নাই আপনি। সেই আপনারে যদি আমি গণিত কেন ভুল শাস্ত্র সেটা বুঝাইতে থাকি দিনরাত, তাইলে দুইদিন বাদেই আপনি আপনার বাতাস ভরা মাথাটা ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে বলবেন, “ঠিক তো! ঠিক তো!”

সত্যের আলো বুঝার পর সেটা আত্মস্থ করাটা প্রথম দায়িত্ব। তা না করে মিথ্যার পশ্চাৎদেশে নিজের মুখ-মাথা অবিরাম ঢুকিয়ে রাখলে তা আর সত্যের আলো কিভাবে দেখবে? সত্যের আলো না দেখলে দুইদিন পর এমনিতেই দুর্গন্ধময় মুখ-মাথা চিৎকার করে বলে উঠবে “সব মিথ্যা।” তাতে সত্য কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না, বাট আপনি আটকায়ে যাবেন।

যোগ অংকের নিয়মটা শিখে নেন। এরপর যোগ অংক সংক্রান্ত যাবতীয় ভুল অংক দেখলে আপনার হাসি আসবে প্রথমে, এরপর বিরক্তি আসবে, এরপর ওইসব অংকের দিকে তাকালেই মনে হবে “ওয়েইস্ট অফ টাইম।”

ভাই, ওয়েইস্ট করার মতো টাইম আপনার নাই, এটা কি আপনি বুঝেন না?

চার

অবশ্যই তোমার অবাধ্যতা ভয়াবহ।
অবশ্যই কোন পাপই ছোট না, তোমারগুলোতো একদমই না।
ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্যেতো এগুলোর একটাই যথেষ্ট।
হ্যাঁ, এতোই জঘন্য ভারী আর বিশাল হয় এক একটা গুনাহ আর অবাধ্যতা।

তবে এর চেয়েও বিশাল আর বড় হচ্ছে আমাদের রাব্বের ক্ষমাশীলতা। নিজের গুনাহকে উনার ক্ষমাশীলতার চাইতেও বড় আর শক্তিশালী ভাবার দুঃসাহস যেনো আর না হয়। তুমি কী? তুমি কে? তোমার গুনাহই বা কী? উল্টাপাল্টা করো না। আর নিজের ক্ষতি করো না। ফিরে আসো পুরোপুরি। মাফ চাও মন থেকে। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেও হাঁটতে থাকো, থেমো না। দৌড়াও তোমার রাব্বের অথৈ গভীর ক্ষমার দিকে। শুরুটাতো করো অন্তত! তারপরেই দেখবে তিনি কিভাবে পরম ভালোবাসায় আর স্নেহে তোমাকে কাছে টেনে নেন!

একটা হাদীস পড়ো। মন ভাল হয়ে যাবে, চোখে পানি চলে আসবে। সহীহ বুখারীর ৭৫০৭ নং হাদীসে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার এক বান্দা পাপ করে আর তারপর বলে, ‘ইয়া আল্লাহ, আমার অপরাধ মাফ করে দিন।’ তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা গুনাহ করেছে আর এরপর বুঝতে পেরেছে, তার এক রব রয়েছেন যিনি গুনাহের জন্য ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন।’

সে পুনরায় পাপ করে আর বলে, ‘ও আমার রব, আমার গুনাহ মাফ করে দিন।’ এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা অপরাধ করেছে, আর তারপর বুঝতে পেরেছে, তার এক রব রয়েছেন যিনি গুনাহের জন্য ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন।’

সে আবারও গুনাহ করে আর বলে, ‘হে আমার রব, আমার পাপ ক্ষমা করে দিন।’ তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা গুনাহ করেছে আর এরপর বুঝতে পেরেছে, তার এক রব রয়েছেন যিনি গুনাহের জন্য ক্ষমা করতে পারেন, আবার তার বিচারও করতে পারেন। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তার যা ইচ্ছা সে তা করুক।”

যতবার মন দিয়ে পড়ি, অনুভব করি, চোখ ভিজে আসে। এতত মহানুভব মালিক আমার! এমন মালিকের দাস হবার সৌভাগ্য ক’জন মানুষের হয়? এতই মহৎ, মহান আর স্নেহময় ক্ষমাশীল তিনি!

তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন তিনি। তবুও কি তুমি বুঝবে না, ফিরবে না? নিজের গুনাহকে, নিজেকে এতো বড় ভাবছো এখনো? তাঁর অপার রাহমাত আর ক্ষমার চাইতেও নিজের অপরাধকে, গুনাহকে বিশাল মনে করবার দুঃসাহস কীভাবে করছো? এতো অহংকার কেনো তোমার?

পাঁচ

ম্যাটেরিয়ালিস্টিক চিন্তা-ভাবনার জগত থেকে Ritual গুলোকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের Spiritual হয়ে ওঠার কথা ছিলো।

কিন্তু যে মনন-মস্তিষ্ক অহম নামক শাইত্বানের কাছে বন্ধক দেয়া, প্রতিপালককে ছেড়ে শাইত্বানের দাসত্বকে বরণ করে নেয়াতেই যে আনন্দ খুঁজে পায়, তার জন্যে উপরের এই কথাগুলো কয়েকটা শব্দে গাঁথা মালার চাইতে বেশি কিছু নয়।

এক একটা দৈব বাণী, এক একটা শব্দ আত্মস্থ করবার জন্যে রাত-দিন পরিশ্রম করবার কথা ছিলো, প্রজ্ঞাগুলোকে ধরতে, বুঝতে চোখগুলো টকটকে লাল হয়ে থাকবার কথা ছিলো, নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে ঊর্ধ্বে না উঠে, অবিরাম পতিত হয়ে, নিজেকে পশুর চাইতেও অধেঃ ফেলে রাখবার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ম্লান হয়ে যাবার কথা ছিলো। অথচ না! এইটুকু বোধ আসবার মতো জ্ঞানও আমাদের হয়নি, তার আগেই যা শিখেছি (বলে ভাবছি) তা জগৎবাসীকে না জানালে শান্তি পাই না।

কেন?

কারণ, আমরা এখনো নিজেকে চিনিনি, বুঝিনি। নিজের সামর্থ্য, শক্তি জানা হয়নি। আমাদেরকে আসলে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে পাঠানো হয়েছে, তা আমরা হয়ে উঠিনি, উঠতেও চাই না। কারণ, আমাদের খায়েশ যে একটাইঃ নিজেকে জাহির করা, অহমের ব্যাগটাকে আরো ভারী করা, আর সেটা নিয়ে গভীরে না ভেবে সেটা নিয়েই অটল থেকে আরো অতলে ভেসে-ডুবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া।

আরো বহু বহু পথ পাড়ি দেয়ার বাকি। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। অন্তত আমার অবস্থা এমনই।

ছয়

প্রতিটা ইন্দ্রিয় ম্যাটেরিয়ালিজম চায়। বস্তুকে ভোগ করতে চায়। কিভাবে? ভেবে দেখো। উত্তর পেয়ে যাবা।

সত্তাকে হতে হবে জিতেন্দ্রিয়। সব ইন্দ্রিয়কে জয় করতে হবে। হবেই। আর এর জন্যেই আত্মসমর্পণ। ছাড়া ছাড়া সমর্পণ না, আত্মাকে পুরোপুরি সঁপে দেয়া। ১০০ তে ১০০ ভাগ সমর্পণ। প্রতিটা ইন্দ্রিয়ের নাকে লাগাম দিয়ে হ্যাঁচকা টান মেরে কন্ট্রোলে রাখার অবিরাম তীব্র অনুশীলন আর একটানা সাধনা। সেই সাধনা জ্বালানী শক্তি পায় সলাতে, আর পূর্ণতা পায় বিরত থাকার মাধ্যমে। অর্থাৎ সিয়ামে।

যাঁরা এই ব্যাপারে সজাগ, তাঁদের সাধনা শুরু হয়েছে আরো আগ থেকে। সাহাবীরাই পাঁচ মাস আগে থেকে শরীর আর মনকে কষে বাঁধবার প্রস্তুতি নিতেন। আর আমরা?

আমরা যারা নিজেদেরকে ইন্দ্রিয়সমূহের দরজায় দাঁড়ানো সচেতন দ্বাররক্ষী ভাবার অভিনয় করছি, তাদের কী অবস্থা? সিয়ামের কিন্তু প্রস্তুতি আছে। মহাপ্রস্তুতি। ম্যাটেরিয়ালিজম থেকে, গায়রুল্লাহর অবিরাম দাসত্ব থেকে নিজেকে এক মাসের কঠিন ট্রেইনিং এ টেনে, ছিলে আনা চাট্টিখানি কথা না। আর তাই রমাদ্বানে আমাদের যে ম্যাটেরিয়ালিজমকে ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা, নিজেকে শরীর-চেতনার চালকের আসনে তুলে বসাবার কথা, সেই রমাদ্বানেও আমাদের টেনশান থাকে খানা-কাপড়ের গাট্টি নিয়ে, আরো কীভাবে ভোগ করতে পারবো তা নিয়ে। যে মুসলিম জাতি পুরো মানবজাতিকে আলোর মশাল দেখানোর কথা, সেই মুসলিমই আজ আঁধারের ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর! এর চেয়ে দুঃখজনক পরিণতি আর হয় না!

তবে, তুমি এর ব্যতিক্রম হতে পারো। সেজন্যে পদক্ষেপটা তোমাকেই নিতে হবে। সিয়ামের কড়া প্রস্তুতি শুরু করো আজ থেকেই। ইন্দ্রিয়ের দ্বারগুলোতে সচেতন পাহারাদার হয়ে যাও এই মুহূর্ত থেকেই। সোম-বৃহঃস্পতির সিয়াম মিস দিও না। বন্ধ করে দাও, বদলে দাও আজাবের সাত দরজাকে রাহমাতের দরজাতে।

ইন শা আল্লাহ, এইটথ গেইট “রাইয়ান”ও খুলে দেয়া হবে তোমার জন্যে। যদি সত্য সায়েম হতে পারো।

শুরু হোক অধ্যবসায়, পরিশ্রম।
সফল হোক সাধনা।

সাত

জীবনের কিছু পর্যায় আসে যখন আল্লাহ অনেক কিছু তাঁর কাছে নিয়ে নেন। মনে করিয়ে দেন, এগুলো আল্লাহরই ছিলো সবসময়, আমাকে কিছু দিনের জন্যে আমানাত দেয়া হয়েছিলো মাত্র। বিনয়ী করার জন্যে, নিজের সত্যিকার পজিশানটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে, দুনিয়ার সত্যতা এবং বিভ্রান্তি বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে তাই হারানোর গুরুত্ব অপরিসীম।

আর হারালেই কেবল মনে পড়ে, প্রাপ্তির তালিকাটা সবসময়ই আল্লাহ কত যতনে ভরিয়ে রেখেছেন। এত্ত অবাধ্যতা আর বেয়াদবীর পরেও জীবনে কোনদিন আমাকে আমার আল্লাহ দুইবেলা না খাইয়ে রাখেননি, এই এত্ত এত্ত ভালোবাসা আমি কোথায় রাখবো?

অভাগা আমরা। বড্ড অভাগা!
আল্লাহ আমাদেরকে কত্ত কিছু দিয়েছেন, সাজিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার চাদরে। আমরা শুধুই তাঁর অবাধ্যতায় ডুবে থেকে সব এলোমেলো করে ফেলি, ঝকঝকে চমকানো অপূর্ব সুন্দর জানালার শার্শিটাও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেই।

তবুও, সেই ভাঙা শার্শি গলেও আমাদের অগোছালো ঘরগুলোতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার তীব্র ভালোবাসার স্নিগ্ধ আলোর বন্যা ঢুকে পড়ে, ভাসিয়ে দেয় সবকিছু।

ও আল্লাহ, এতো ভালোবাসো কেন আমাদের?
এত্ত কেনো?

আট

তোর জমি যারা কেড়ে নিয়েছে, তোর ভিটে মাটি থেকে তোরই ফ্যামিলিকে যারা হিড়হিড় করে টেনে ছেঁচড়ে বের করে দিয়েছে,
তোর বোন, মা, কন্যার পবিত্রতা যাদের নোংরা, অপবিত্র পাশবিক হাতে বন্দী হয়ে প্রতিদিন অমানবিক অত্যাচারে লাঞ্চিত, নিষ্পেষিত হয়ে পড়ে আছে, আত্মহত্যা করতে চেয়েও পারছে না, সুযোগ নেই,
যে পশুদের হাতে তোরই বাবার খুলি উড়ে গেছে, তোরই এক শিশুর হাত-পা গুড়িয়ে ছিঁড়ে নিয়েছে যারা,
তোরই ভাইয়ের বুককে যারা সীসার উত্তাপে ভিজিয়ে চিরিয়ে উল্লাস করেছে,

তুই সেই জানোয়ারদের সভ্যতা চাস! এত্ত অসভ্য তুই!
তুই তাদের দেখানো সাফল্যে সফলতা খুঁজিস! এতোটাই আন্ধা-কানা তুই!
তাদের প্রশংসা না পেলে তোর মনের পেট ভরে না! এত্তো ঘিনঘিনে লোভ তোর!
জ্ঞানার্জন করতে গেলেও ওদের স্বীকৃতি না পেলে তোর দম বন্ধ হয়ে আসে! কী যেনো নাই, নাই লাগে! ওয়াহরে জ্ঞানী, ওয়াহ!

দিনরাত তুই ওদের মতো হতে চাস, ওদের দেখানো স্বপ্ন দেখোস, ওদের সাথে থাকতে চাস, ওদের বেড়ি নিজের গলায় পরে নিয়ে মননে-চলনে ওদের পোষা কুত্তা হওয়াই তোর এইম ইন লাইফ!

হেই, তুই কি মানুষরে?
আমি থুঃ দিই তোর মুখে। একদলা থুঃ!
থুঃ থুঃ!

কী ব্যাপার?
আমার মুখটাই ভিজে যাচ্ছে কেন প্রতিটা থুথুর দলায়?

ওমা! এ যে দেখি আমারই মুখ।
তীব্র ঘেন্নায় ছুঁড়ে দেয়া থুথুতে থকথকে ষাদায় ডুবে আছে!

নিজের দিকে তাকানো যায় না আর।
আমি তাহলে এতোটাই কুৎসিত! এতোটাই নীচ আর জঘন্য!

তোর সাথে আমার মিল আছেরে। তুই আর আমি না থাকলে দুনিয়াতে দুইটা কদর্য অন্তত কম হতো, ঠিক না?

নয়

সত্যটা বুঝার পর মানতে গেলেই শুরু হয় বিপত্তি। বড় বড় ত্যাগ-তিতীক্ষাগুলো তুচ্ছাতিতুচ্ছ হলেও চারপাশের চাপে সেগুলোকেই মনে হয় সুবিশাল। এখনো না বুঝতে পারা মানুষগুলো তোমার মূল্যবান জীবনটাকে সংকুচিত করে দেয়, করে দেয় আরো আরো সংকীর্ণ। সত্য পথে চলতে গিয়ে নিজের কুপ্রবৃত্তির সাথে ভয়াবহ যুদ্ধের পাশাপাশি যুক্ত হয় সামাজিক সন্ত্রাসে জন্ম নেয়া নাভিশ্বাস। তারপরেও তুমি হাল ছাড়োনি কখনো, ছাড়ার কথা চিন্তাও করতে পারো না। কারণ, তুমিতো লজ্জা পাও তোমার রবের সামনে অবাধ্যতা আর ভুলের গ্লানি নিয়ে দাঁড়াতে। তুমিতো জানো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“জাহান্নামকে লোভনীয় জিনিস দ্বারা আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছে। আর জান্নাতকে রাখা হয়েছে দু:খ কষ্টের আবরণে।” (আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত; বুখারী ৬৪৮৭)

সবইতো বুঝলে। এখন বলো, ঈমান এনেছো?
তাহলে প্রস্তুতি নাও। একের পর এক মহাঝড়ের ধাক্কা সামলাতে হবে। তার মোকাবিলায় নিজের সত্তাকে শক্তিশালী করো।

প্র চ ন্ড শ ক্তি শা লী।

প্রতিরাতে শরীরটাকে বিছানা থেকে ছিলে তুলে আঁছড়ে ফেলতে শিখো জায়নামাজে।
বাইরের মহাযুদ্ধে জিতবার মহড়ার মহাযজ্ঞ শুরু হোক ভিতর থেকে।
আজ থেকেই।

প্রতিরাতে।

এ কা ।

দশ

নিজেকে না চিনলে, নিজের সত্য স্বরূপ না বুঝলে চেতনা কী তাই বুঝা হবে না।

চেতনা না থাকলে সত্যিকারের সচেতনতা (তাক্বওয়া) আসবে না।

সত্যিকারের সচেতনতা না থাকলে সত্য পথের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়ে থাকলেও, অন্তর্চক্ষুর অভাবে অন্ধ তুমি তা দেখতেই পাবে না।

তাই চেতনাকে জাগিয়ে রেখে অতি-সচেতন (মুত্তাকী) হওয়াটা খুবই গুরুত্ববহ। খুবই। পথের দেখা পেতে সচেতনতা সবচেয়ে দরকারী বিষয় হওয়াতে সবার আগে, সবকিছুর শুরুতে এটাই কিন্তু বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। আল-কুর’আনের সুরা বাক্বারার ২য় আয়াতটা খেয়াল করেছো কখনো?

যা লিপিবদ্ধ হয়েছে (কিতাব), যাতে কোন সন্দেহই নেই, তা অক্ষর আর ধ্বনির সীমাবদ্ধতার চাইতেও আরো অনেক, অ-নে-ক বেশি কিছু। এটা না বুঝলেও ভুলে যেও না প্লিজ। ভুলে যেও না যে, তুমি সদা সচেতনতায় জেগে না থাকলে, অন্তর্চক্ষু খোলা না থাকলে তাঁর দেখানো পথ দেখেও দেখতে পাবে না।

এ সেই জ্ঞান, সত্য জ্ঞান, যা আসে সত্যের উৎস থেকে। আর সেটা যে আমাদের সীমিত পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধ মাত্রার পাতায়-ছায়ায় আবদ্ধ নয়! এ যে অন্য মাত্রার, মাত্রারও বাইরের! তোমাকে কিভাবে বুঝাই বলো!

জাস্ট এইটুক জেনে রাখো, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতেই পাবে শুধু। অন্য কোথাও হতে নয়। কক্ষনো নয়।

তাই তাঁর কাছেই জ্ঞান আর সত্য ভিক্ষা চাও।
তাঁর কাছেই ফিরে আসো।
অন্য কোথাও না।