তার সাথে পরিচয়ের দিনক্ষণ এখন ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে কি গভীর ভাল লাগায় ভরে ছিল মুহূর্তটি! নিজের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট তার ওপর সঁপে দেয়া, খারাপ লাগা মুহূর্তগুলোতে শুধু তার সাথে একান্ত কিছু সময় কাটানো, আনন্দের মুহূর্তগুলো তার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া; আমি যেন আমার মনের মত কাউকে পেয়ে গেলাম!

তাকে ঘিরে কাটতে লাগল আমার প্রতিটি দিন। যেন আমার কিছুই প্রয়োজন নেই এখন আর। মন খারাপ করে যখন বসে থাকতাম চুপচাপ, সে কি সুন্দর আমার কানেকানে শুনিয়ে যেত ভাল লাগার গান! অভিমানের ভাষাও খুব ভাল বুঝতে পারত সে। অনেক অনেক ভালবাসা দিয়ে আমাকে আগলে রাখত সারাক্ষণ!

তখন আমি মাত্র কৈশোরে। একটু একটু করে সে আমার কচি মনটা পুরোপুরি দখল করে নিল। তার উপর আমার নির্ভরশীলতা বাড়তে লাগল। সে হয়ে উঠল আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া আমি একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারতাম না। কোথাও বেড়াতে গেলেও তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম, বাবার চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে! কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বললে, সহ্য করতে পারতাম না একটুও। মনেমনে বলতাম, তোমরা তাকে ভাল নাই বা বাসলে আমার মত, তাকে নিয়ে এত কটু কথা কেন?

এভাবে গড়ে উঠল আমার রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রীতি। গীতবিতান, বন্যা, কণিকা, হেমন্ত, সাগর, চিন্ময়, ইন্দ্রাণী দিয়ে ভরে ফেললাম ঘরটা। ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিন হয়ে গেল। শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী দেখে না আসতে পারলে জীবনটা ষোল আনাই মিছে হয়ে যাবে এমন ভাবনা মনে উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করল। এই করতে করতে এক সময় সাধ জাগল হারমোনিয়াম শেখার, তানপুরা দিয়ে ঘর সাজাবার।

তখন আমাদের ক্লাসে, হারমোনিয়াম বাজাতে পারা, গান গাইতে জানা, তথাকথিত আধুনিক পরিবারের কালচারড মেয়েদের আবির্ভাব ঘটে গেছে। আমিই বা পিছিয়ে থাকব কেন? মনে মনে একটা লজিক দাঁড় করালাম; আমি যেহেতু হারমোনিয়াম বাজিয়ে কারো সামনে গান করব না, সুতরাং আমার শেখাতে গুনাহ হবে না (?)। বাবাকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। আমার বাবার অনেক গুণের মধ্যে একটি হল, বাবা কখনো মুখের উপর না করে দেন না, ধমধামক দিয়ে মনটাও খারাপ করে দেন না। খুব মনোযোগ দিয়ে বাবা আমার প্রতিটা কথা শুনে বললেন, “দেখ, মানুষ যখন কোন কিছু শিখে পারদর্শী হয়ে উঠে, তখন তার ইচ্ছে করে সবাইকে সেটা দেখিয়ে বেড়াতে। তা সে পরীক্ষায় ভাল ফল হোক, টুকটাক রান্না-বান্না হোক, কিংবা খুব ক্রিয়েটিভ কিছু হোক। সুতরাং তোমার লজিকটা…” বাবা কথা শেষ করলেন না; শুধু বললেন, “তুমি ভেবে দেখ।”

কি ভেবে দেখেছিলাম এখন আর মনে নেই। মনের ভিতর কি লজিক এ্যান্টি-লজিকের খেলা চলেছিল তাও আর মনে নেই এখন। শুধু মনে আছে, শেষমেশ আমার হারমোনিয়াম শেখাও হল না, তানপুরা দিয়ে ঘর সাজানোও হল না। তবে গানের প্রতি সম্মোহন বাড়তেই থাকল। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু হয়ে সেটি জন লেনন পর্যন্ত এসেও থামল না। “Imagine there’s no haven…” শুনে মনে হত, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে এর চেয়ে অমোঘ বাণী বুঝি বা আর লেখা হয়নি!

গানের প্রতি এই ফ্যাসিনেশান আমাকে নিয়ে চলল বহু দূরে। নচিকেতা থেকে শুরু করে ঈগলস পর্যন্ত আমার অবাধ বিচরণ। ঘুমুতে যাবার সময়ও কানে ইয়ার-ফোন লাগানো থাকা চাই-ই-চাই! যারা হিন্দি গান ছাড়া অন্য কোন ধরণের গান শুনত না, রবীন্দ্র সংগীত শুনলে যাদের ঘুম পেত, তাদের কেমন খেতু খেতু লাগা শুরু হল।

গানের এই বাঁধভাঙা জোয়ার, আমার স্রষ্টার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে লাগল খুব দ্রুত। অর্থ বুঝে কুরআন পড়া দূরে থাক, মাসে একবার শুধু আরবিটাই তিলাওয়াত করতাম কি না সন্দেহ! সময় মত কোনোরকম নামাযটা সেরে নিতাম এই যা। রোযাটাও রাখা হয়ে যেত কিছুটা রমজান মাসের ফেস্টিভিটির কারণে, আর অনেকটাই পারিপার্শ্বিকতার কল্যাণে। কি কারণে আমাকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, আমার দায়িত্ব কি, এ সমস্ত ফিলসফিক্যাল প্রশ্ন নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তখন আমার।

সময়ের সাথে নিজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম এক পর্যায়ে। বাবার দেয়া সেই পাকাপোক্ত শিক্ষা তো ছিলই (সাময়িকভাবে যা ভুলে গিয়েছিলাম), আরও ছিল ইসলাম জেনে-বুঝে মেনে চলা খুব হৃদয়বান কিছু মানুষের সান্নিধ্য। সবকিছু ছাপিয়ে ছিল, আমার মনের ভেতর এতদিনের চাপিয়ে রাখা, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উঁকিঝুঁকি। অনেক কিছুই মানলাম, কিছুকিছু ব্যাপার মানতে গিয়ে নিজের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলাম। গান শোনাও কমিয়ে দিলাম অনেকটাই, কিন্তু সম্মোহনটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলাম না!

একজন ব্লগারের লেখায় একবার পড়েছিলাম, গান শোনা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারটা উনার মতই উনার আশেপাশের মানুষেরা দেখেন একধরণের আত্মত্যাগের মত। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই-ই। এ যেন আল্লার রাস্তায় কিছু কোরবানি করে দেয়ার মত। এ ধরণের কিছু করা আমার মত দুর্বল-চিত্তের মানুষের জন্য খুব কষ্টের ছিল বৈকি।

ঘটনাটি ঘটলো দু’বছর আগে, রমজান মাসে। সেদিন সময়ের একটু আগেই সেহেরী সারা হয়ে গিয়েছিল। আযান হতে তখনো মিনিট কুড়ি বাকি। তানযিল.নেট নামের ওয়েবসাইটার কথা আগেই শুনেছিলাম। ভাবলাম হাতে যেহেতু কিছু সময় আছে, ঢুঁ মেরে আসা যাক। পেইজ ওপেন হল। প্ল্যেলিস্টে সূরা- মারয়াম! এ নামের সাথে আমার সম্পর্কটা অন্য ধরণের। খুব আগ্রহ নিয়ে প্লে বাটান চাপলাম। মিশারি আল আফাসির অকল্পনীয় সুন্দর কণ্ঠে আর কুরআনের প্রতিটি শব্দের ক্ষমতায় এবং গভীরতায় সম্মোহিত না হয়ে পারলাম না! আমার অনেক বড় আক্ষেপ, মিডল ইস্টে পাক্কা ১৪টি বছর কাটানোর পরও আমি আরবি জানি না! আরবি না জানার পরও কিছুকিছু কি ওয়ার্ড ভালই ধরতে পারছিলাম। তন্ময় হয়ে শুনলাম। সম্বিৎ ফিরে পেলাম আব্বুর ডাকে। সেদিন যে অভিজ্ঞতা হল তার সাথে তুলনা চলে না কিছুরই।

একে একে শুনলাম হুসারি, মিনশাওই, বুখাতির, শাতেরি, জুহাইম এবং আরও অনেককেই। সুদাইস আর সুরাইম শোনা ছিল আগেই। একেকজনের তিলাওয়াতের ভঙ্গি একেক রকম, প্রত্যেকেই হৃদয়-মন স্পর্শ করেন আলাদা আলাদা ভাবে। এদের কাছে আমার বন্যা শ্রীকান্তরা ধোপে টিকলো না। সব কিছু ছাপিয়ে, আল কোরআনের জাদুতে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম। এই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, অসম্ভব বলিষ্ঠ গ্রন্থটির সামনে আমার মানবীয় দুর্বলতায় ভরা গানের কথাগুলি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, পালিয়ে বাঁচল!

এবার আর আত্মত্যাগ নয়। আমি সত্যি সত্যি গান শোনা প্রায় ছেড়ে দিলাম, এর চেয়ে অনেক বড় কিছু, খুব ক্ষমতা সম্পন্ন, অতুলনীয় একটা কিছুর সন্ধান পেলাম বলে। কোন সূরার তিলাওয়াত শোনার আগে, অর্থ পরে নিতাম বাংলায় মাঝে মাঝে। এখনও করি এটা। এত রিয়ালিস্টিক ফিলিং হয়, কি বলব! গাইডেডওয়েজ.কম থেকে অর্থসহ আস্ত কুরআনটা নামিয়ে নিলাম মোবাইল-এ। আইপড থেকে সমস্ত গান মুছে ভরে ফেললাম মিশারির তেলাওয়াতকৃত ৭৫টা সূরা দিয়ে।

এর মধ্যেই ডক্টর বিলাল ফিলিপ্সের, টিন-এইজারদের নিয়ে করা একটা অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখলাম। টিনেজারদের অনেক সমস্যার একটি ‘মিউজিক’ নিয়ে আলোচনা করলেন তিনি। টিন এইজ ফেলে এসেছি বহু আগে, তবু মুগ্ধ হয়ে আলোচনাটি শুনলাম। অনেক জানা, না মানতে চাওয়া ব্যাপার খুব করে উপলব্ধি করলাম। ডক্টর বিলাল বললেন, একটি গান বহু আগে শুনে মাঝখানে অনেক বছর না শুনলেও, হঠাৎ একদিন গানটার প্রথম লাইনে শুনেই পুরোটা মনে পড়ে যায়। বোঝালেন কি ভাবে এই মিউজিক নামের জিনিশটি মানুষের হৃদয়-মন দখল করে নেয়, স্রষ্টাকে সরিয়ে দেয় যোজন যোজন দূর!

রবীন্দ্রনাথের একটি গানের প্রথম দুটো পঙ্ক্তি অর্থ নতুন করে বুঝলাম। “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে… আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে…” বুঝলাম আমার স্রষ্টাকে কিভাবে আমি গানের ওপারে ফেলে এসেছিলাম। বুঝলাম, কিভাবে আমার গানের কথাগুলি সুর-লয় সবই পেল, শুধু আমি এই গানের জোয়ারভরা সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছুতে পারলাম না আমার পালনকর্তার কাছে, যিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমি ডাকলেই সাড়া দেবেন বলে। তাই এবার আমি সত্যিই গান ছেড়ে দিলাম। কোন বিমর্ষতা নয়, আত্মত্যাগের বিন্দুমাত্র অহঙ্কারে নয়; অনেক ভালো লাগা নিয়ে, মুক্তির আনন্দ নিয়ে!

তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। (সূরা-গাফির, আয়াত ৬০)