নিজেকে আবিষ্কার করা বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ নিজের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি এখনো নিজেকে আবিষ্কার করতেই ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি কি সেক্যুলারিজমের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন, নাকি ইসলামের পাটাতনে, না অন্য কোনো বিশ্বাসের, তা তিনি নিজেই ঠাহর করতে পারেন না। তাই দেখা যায় ইসলামে বিশ্বাসী হয়েও অনেকে ইসলামের মৌলিক কাঠামোর বাইরে সিদ্ধান্ত দিয়ে বসেন। এক্ষেত্রে তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেন যে, সামান্য বিরোধিতাও তারা সহ্য করতে চান না। নিজের সিদ্ধান্তকে ভারসাম্যপূর্ণ দাবি করে বিরোধীদের প্রান্তিক, গোঁড়া, মূর্খ ইত্যাদি বলে বসেন তারা।

সমাজে বহুল প্রচলিত এ ধরনের একটি আচরণ হলো, মৃত কাফেরের আত্মার জন্য শান্তি কামনা করা। কাফেরও আল্লাহর রহমত পেতে পারে বলে ঘোষণা করা। সাধারণত সেলিব্রেটি কাফেরদের (বা স্বঘোষিত নাস্তিকদের) মৃত্যুর পর এই কথাগুলো খুব প্রচার হতে দেখা যায়। কোনো কাফের বা নাস্তিকের মৃত্যু হলে সেক্যুলারিজমের ধ্বজাধারীরা তার আত্মার শান্তি কামনা করে, একই সময় সেক্যুলারদের অনুকরণে সাড়া দিয়ে উঠে মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়হীন একটি গোষ্ঠী। তাদের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর তবে বেশ স্পষ্ট। তাদের বক্তব্যের সারকথা হলো, আল্লাহর রহমত অনেক প্রশস্ত। কাফেরকে মাফ করার বিষয়টি তাঁর ইচ্ছাধীন, তিনি চাইলে মাফ করতে পারেন, এক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই। যেহেতু বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন, তাই তাঁর কাছে মৃত কাফেরের জন্য দোয়া করতেও সমস্যা নেই।

যদি তাদের কথার প্রতিবাদ করা হয়, কিংবা বলা হয় কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কেউ আল্লাহর রহমত পাবে না, তাহলে তারা বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এক্ষেত্রে সাধারণত তারা স্বগোত্রের মুসলমানদের সাথে তীর্যক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, যদিও কাফেরদের বিষয়ে তাদের অবস্থান খুবই নমনীয়। মুসলিম সমাজের এই শ্রেণীটি খুব গৎবাঁধা কিছু কথাবার্তা বলে থাকেন। তাদের মতে, আল্লাহর রহমত আল্লাহ কাকে দিবেন আর কাকে দিবেন না, সেটা আল্লাহর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এখানে অন্য কারো মাতবরি করার সুযোগ নেই।

মৌলিকভাবে কথাটি সঠিক। অবশ্যই আল্লাহর রহমত বণ্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজেই সিদ্ধান্ত নেন। এখানে অন্য কেউ কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারে না। তবে আল্লাহর রহমত কারা পাবে তা আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন,

وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَـاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

আর আমার দয়া সে তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি এ রহমত (পরিপূর্ণভাবে) সেই সব লোকের জন্য লিখব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং যারা আমার আয়াত সমূহে ঈমান রাখে। [আরাফ, ১৫৬]

وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। [হুজুরাত, ১০]

এই আয়াতগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তাঁর রহমত মুমিনদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। এবার দেখা যাক কাফিরদের ক্ষেত্রে তিনি কী বলেছেন। কাফিরদের ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا

নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছেন। [আহযাব, ৬৪]

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করতে চায় তাঁর থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [আলে ইমরান, ৮৫]

وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ وَلِقَائِهِ أُوْلَئِكَ يَئِسُوا مِن رَّحْمَتِي وَأُوْلَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ ও তাঁর সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারাই আমার রহমত থেকে নিরাশ হবে এবং তাদের জন্যেই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। [সুরা আনকাবুত, ২৩]

فَلَعْنَةُ اللَّه عَلَى الْكَافِرِينَ

অতএব কাফেরদের জন্য রয়েছে আল্লাহর লানত। [বাকারা, ৮৯]

এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট কাফেরদের জন্য আল্লাহ পরকালে নিজের রহমত বণ্টন করবেন না। একইসাথে কাফেরদের ব্যাপারে ক্ষমাপ্রার্থনা কিংবা দোয়া করার বিষয়টিও আল্লাহ তাআলা নিষিদ্ধ করেছেন এভাবে,

اسْتَغْفِرْ لَهُمْ أَوْ لاَ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِن تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّةً فَلَن يَغْفِرَ اللّهُ لَهُمْ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللّهِ وَرَسُولِهِ وَاللّهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

(হে নবী) তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর একই কথা। তুমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তবু আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তা এ কারণে যে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে কুফরি করেছে। আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াতপ্রাপ্ত করেন না। [তাওবা, ৮০]

সবগুলো আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন কাফেরদের ব্যাপারে বিশ্বাস কী হবে এবং মৃত কাফেরের সাথে আচরণ কী হবে। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করছেন, কাফের ব্যক্তি আল্লাহর রহমত পাবে না এবং মৃত কাফেরের জন্য দোয়া করা না করা সমান, তাতে তার কোনই উপকার হবে না।

এখন কেউ যদি কোনো বিধর্মীর ইন্তেকালে বিষয়গুলো অন্যদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তিনি কোরআনি নির্দেশনা প্রচার করছেন মাত্র, কে আল্লাহর রহমত পাবে না পাবে সে বিষয়ে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। অপরদিকে যারা বলছে আল্লাহর রহমত প্রশস্ত, তিনি চাইলেই কাফেরকে ক্ষমা করতে পারেন, তারা ভুলে যাচ্ছে আল্লাহ নিজেই বলেছেন কাফের তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বুঝা গেল এই লোকেরাই মূলত আল্লাহর রহমত কে পাবে আর কে পাবে না সেক্ষেত্রে নিজেরা মাতবরি করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। যদি সে বাস্তবেই বিশ্বাস করে থাকে আল্লাহর রহমত কোনো মাখলুকের হাতে নেই, তাহলে তার এটাও বিশ্বাস করা উচিত যে আল্লাহ নিজেই বলেছেন তাঁর রহমত তিনি কোনো কাফেরকে দিবেন না।

অথচ দেখা যায় এই শ্রেণীটি প্রথম বিষয়টি বিশ্বাস করে (অন্তত মৌখিক স্বীকৃতি দেয়) কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়ে এসে তারা বলে থাকে আল্লাহ চাইলে কাফেরকেও রহমত করতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে তারা কাফেরদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজকর্ম ইত্যাদির দলিল টেনে বলে, আল্লাহ অবশ্যই তাঁর এসব ভালো কাজের বিনিময়ে তাকে জান্নাত দান করতে পারেন।

আল্লাহর রহমত বণ্টন আল্লাহর নিজস্ব সিদ্ধান্ত এই কথা বলে তারা নিজেরাই কাফেরের উপর সেই রহমত বণ্টনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে? এ ধরনের লোকদের লক্ষ্য করেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ

তারা কি আপনার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে? [যুখরুফ, ৩২]


আঁধারশেষে আলোর রেখা