মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার জাহেল আর অজ্ঞতার জীবনের কথা ভাবি। স্কুল জীবনের বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস কিংবা কলেজের ছন্নছাড়া জীবনের উন্মাদ আকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়ানোর কল্পিত স্বপ্নময় জীবনের পাণ্ডুলিপি আমাকে এখনো কষ্ট দেয়! হুমায়ূন সাহিত্য, এফ এম জগতের অদ্ভুত রুচিহীন স্বপ্ন, গানের কলি কিংবা সেলুলয়েডের আবেগময় অভিনয়ের জীবন থেকে পাওয়া ভাবাবেগ অন্য সবার মত আমার মনের মধ্যেও নিয়ে এসেছিল কল্পনার রাজকন্যাদের! ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কল্পনার নায়ক বনে গিয়ে কল্পিত রাজকন্যার অদৃশ্য উপস্থিতি, উথালপাথাল জোছনায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে হিমু হওয়ার বাসনা কিংবা স্কুলের বন্ধুদের অমুক+তমুক দুষ্টুমির মধ্যেও কল্পনায় কাউকে নিয়ে প্রেমাবেগের উৎপত্তি—এসবই আর দশটা জীবনের মত নিজের জীবনে সবারই ঘটে! সবকিছুর মাঝেও মূল্যবোধের রশি ছিঁড়ে পাগলা ঘোড়া হয়ে যায়নি কিংবা সেক্যুলার সমাজের নোংরা সিস্টেমের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলিনি, কিন্তু তাই বলে অনুভূতিগুলো ভোতাও হয়ে যায়নি। আবেগগুলোও ছেড়ে যায়নি। প্রেমাবেগ, স্বপ্ন, অনেককিছুর চাহিদা নিয়ে আর দশজনের মত এই নষ্ট সমাজে এখনো বেঁচে আছি আলহামদুলিল্লাহ।

কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন সংগ্রাম করতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। নিজের কামনা বাসনা আর নফসের সাথে সংগ্রাম করে একা একা বেঁচে থাকার তীব্র কষ্টের মাঝে বুকের অনেক গভীর থেকে অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাসের সাথে মাঝে মাঝে এধরনের লেখাগুলো বেরিয়ে আসে….

কালের বিবর্তনে জীবনবোধের পরিবর্তনে আল্লাহ্‌র করুণার পাত্র হয়ে আজ আমি জানি জীবনের একটা সুন্দর অর্থ আছে। আমি সেই জীবনটাকেই বেছে নিয়েছি যে জীবনটা আনুগত্যের মহান আল্লাহ্‌র প্রতি। তাঁর আদেশ নিষেধগুলো মেনে নেওয়ার এক জীবনব্যবস্থা ইসলামের ছায়াতলে এসে নফসের সাথে লড়াই করাটা কতটা কঠিন তা হয়তো অন্য জাহেল ছেলেদের কাছে হাস্যকর লাগতে পারে। একদিন আমার এক বন্ধুকে কুরআনে নন মাহরামের সাথে পর্দা করার আয়াতের কথা জানালে সে পারলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। মাথা নিচু করে ভাবছিলাম, এই ছেলেটার কাছে এই বিষয়টা কত অর্থহীন! সন্ধ্যার পরের ক্যাম্পাসে কোনদিন বের হলে প্রায়ই আমার মনে হয় একটা পতিতালয়ে আছি। ঝোপে ঝাড়ে, আবডালে খদ্দেররা বসেছে তাদের পছন্দের পতিতা নিয়ে! শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এর চেয়েও ভয়ংকর! আল্লাহ ক্ষমা করুন। গার্লফ্রেন্ডের সাথে শারীরিক সম্পর্কের রুচিহীন বর্ণনা বন্ধুদের শুনিয়ে মজা পায় অনেকেই। যত বেশি মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে যত বেশি ব্রেক আপ করা যায় এর মাঝেও কৃতিত্ব দেখায় কেউ কেউ। আমার মুখের দাড়ি দেখে কেউ কোনোদিন আমাকে জিজ্ঞেস করার কথা না আমার গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা। ক্লাসে কোন মেয়ের সাথে কথা বলছি এই দৃশ্যও কেউ কল্পনাতেও ভাবতে পারবে না! সবসময় সাধু হুজুর, good boy image এর ছেলে ভাবতে ভাবতে কেউ ভাবতে না পারলেও আমি তো ভাবি আমি একজন মানুষ। আধুনিক বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডের রসালো বর্ণনা শুনতে শুনতে কোনদিন আক্ষেপ না হলেও মন থেকে দীর্ঘশ্বাস তো বেরিয়ে আসেই। ললনাদের শরীর প্রদর্শনীর জাহেল ভার্সিটি ক্যাম্পাসে চোখ নামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজকাল বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগে। সবাই অনেক ভালো ছেলে ভেবে বসলেও অন্তর ছিঁড়ে তো আর কেও দেখেনা। দেখেনা আমারও আবেগ আছে। দেখেনা হুজুররাও মানুষ!

অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে girlfriend শব্দের অর্থ হল “a person’s regular female companion in a romantic and sexual relationship.” Boy friend শব্দের অর্থও একই শুধু female এর জায়গায় male!! একজন ছেলে কিংবা একজন মেয়ে কাছাকাছি আসে কিংবা সম্পর্কে জড়ায় তাদের কিছু মানসিক এবং শারীরিক চাহিদার পূরণের জন্য কারণ আমরা জানি প্রাকৃতিকভাবে এই চাহিদা পূরণে ছেলে মেয়ে একে অপরের পরিপূরক! সুবাহানাল্লাহ! ছেলে মেয়েদের এই চাহিদা পূরণের জন্য তাদেরকে নিজেদের ইচ্ছামত ছেড়ে না দিয়ে ইসলাম একটা ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যা মানুষের মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর সামাজিক পরিপূর্ণতার বিচারে মানুষকে মানসিক, শারীরিক চাহিদা পূরণে শরিয়াগতভাবে বৈধতা দেয়। আর ইসলামের এই ধারণার নামই বিয়ে! সমাজের প্রচলিত নোংরামি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা একজন যুবকই বুঝে বিয়ের গুরুত্ব কতটুকু! নোংরা সমাজের নোংরামিতে হাবুডুবু খাওয়া আধুনিক তরুণ তরুণীদের কাছে হয়ত আমার বয়সে বিয়ের চিন্তা একটা হাস্যকর পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তাই মানুষকে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে বুঝাতে একদিন মাথা নিচু করে লজ্জায় লাল হয়ে যখন বাড়িতে একজনকে বিয়ের ইচ্ছের কথা বলেই ফেললাম; বাড়ির ছোট ছেলের এমন প্রস্তাবে রিক্টার স্কেলে মোটামুটি মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল! কান্নার রোল পড়ে গেল আমার লজ্জাহীনতায় (!)! মাথা নিচু করে সেদিনও সহ্য করে গিয়েছি এই সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতা!

আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা মায়েরা কখনো বুঝতে চায়না লেখাপড়া, ক্যারিয়ার, চাকরী বাকরির যান্ত্রিক আটপৌরে জীবনের পেছনে ছুটে চলা তাদের সন্তানেরাও মানুষ। তাদেরও চাহিদা আছে শরীর আর মনের। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ভর্তি করিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা বাবা মায়েদের সন্তানদের আমি ঢের দেখেছি! বাবা মায়েদের কাছে সাফল্যের স্বীকৃতি পাওয়া ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধ, নৈতিকতাহীন জীবনও আমি দেখেছি! আমি জানি এসব ছেলেমেয়েদের বাবা মায়েরা মানুষের কাছে ঠিকই গল্প করে বেড়ায় “আমার ছেলে কিন্তু আর দশজনের মত না”, “আমার মেয়ে কিন্তু আর দশজনের মত না!” কিন্তু আমার ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই “আর দশজনের মত না” তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা বাবা মায়েদের সন্তানদের যান্ত্রিক জীবনের নৈতিকতাহীন জীবনগুলোই অর্থহীন হয়! মাসের পর মাস ঢাকা শহরে দেশের সবচেয়ে জাহেল একটা ভার্সিটিতে নফসের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা আমি চাইলেই যে হাজারটা নষ্টামিতে গা ভাসিয়ে দিতে পারি এটা না বোঝা আমার পরিবার ঠিকই বুঝে এই বয়সে বিয়ের কথা তোলাও একটা লজ্জাহীনতা!

Comapanion, romantic and sexual relationship এর সংজ্ঞায় girlfriend, boyfriend এর অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া সেক্যুলার সমাজ এই সম্পর্কের সহজ সমাধানের পথে না হাঁটলেও মহান আল্লাহ বলছেন কুরআনে,

“আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের (মানব জাতির) মধ্য থেকেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য (বিপরীত লিঙ্গের) জুড়ি, যাতে করে তোমরা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো! এ উদ্দেশ্যে তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন হৃদ্যতা- বন্ধুতা আর দয়া- অনুগ্রহ অনুকম্পা। এতে রয়েছে বিপুল নিদর্শন চিন্তাশীল লোকদের জন্য।” [৩০:২১]

আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তায়ালা বিয়ের এই পবিত্র বন্ধনকে এত সহজ করে দিয়েছেন স্বাধীন মহিলাকে বিয়ে করতে না পারলে অধীনস্থ দাস এমনকি আহলে কিতাবদেরও বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যাতে সমাজে অশ্লীলতা, ব্যভিচার এর বিস্তার না ঘটে। যুবক যুবতিরা যাতে নিজেদের পবিত্র করতে পারে। তাদের অন্তরের শূন্যতাগুলো যেন পূরণ করতে পারে সেজন্যই মহান আল্লাহ পাক বিয়ের ব্যাপারটা এত সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু সেই সহজ ব্যাপারটাই নফসের গোলাম এই সেক্যুলার সমাজ কঠিন বানিয়েছে বিনিময়ে সহজ করে দিয়েছে অশ্লীলতা আর ব্যভিচার! নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে বিয়ের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করতে চাওয়া যুবকদের আজ শুনতে হয় "বিয়ের পরে বউরে খাওয়াবি কি?!" অথচ সবাই ঠিকই বিশ্বাস করি রিযিক আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই আসে! সবাই ঠিকই বিশ্বাস করলেও বিয়ের আগে ছেলের ব্যাংক ব্যাল্যান্স আর সফল ক্যারিয়ার পাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। হুজুরদের কোন দাম নেই। হিজাবিরাও আজকাল বিয়ের সময় টম ক্রুজ আর বিল গেটস খুঁজে! আল্লাহু আকবর! আল্লাহ সহজ করুন।

রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীরা (রাঃ) যখন মক্কার মুশরিকদের মানসিক আর শারীরিক অত্যাচারে নিষ্পেষিত হচ্ছিলেন তখন আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বললেন,

“ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” [২:১৫৩]

আমি জানি আমার মত নফসের সাথে লড়াই করে যাওয়া অসহায় অবিবাহিতরা ধৈর্য ধরেই আছে। আল্লাহ্‌র কাছে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য প্রার্থনা করেই আছে।

মেঘ কালো করে ঝুম বৃষ্টি নামলে মাঝে মাঝে এখনো জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বুক ভরা শূন্যতায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাই কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়াক! রাস্তায় আঁটসাঁট পোশাকের ললনাদের দেখে দৃষ্টি নামাতে নামাতে ক্লান্ত হয়ে খুব করে চাই কেউ একজন আমার জন্য চক্ষু শীতলকারিণী হোক! কেউ একজন আমার মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করুক! কেউ একজন আমাকে সান্ত্বনা দিক। কেউ একজন আমার দ্বীনের পথের সঙ্গী হোক। আমার ভুলগুলো দেখিয়ে দিক।

ইসলামের বিজয়ের পতাকা একদিন এই জমিনে উড়বে, এই স্বপ্ন যেমন দেখি তেমনি স্বপ্ন দেখি ইসলামের সেই সত্য আর সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার যেখানে ছেলেমেয়েদের কামনা বাসনার সাথে লড়াই করতে হবেনা, একজন সুকুনের জন্য আহাজারি করতে হবেনা। জীবনসঙ্গিনীর খোঁজে ব্যাংক ব্যালেন্সের ওজন মাপতে হবেনা। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন মূল্যবোধ আর নৈতিকতার সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে ছেলেমেয়েদেরকে নিজের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শরীর সওদা করে বেড়াতে হবেনা। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের কাছে চাহিদার হিসাবে আত্মতুষ্টি খুঁজতে হবেনা। ফেসবুকের ইনবক্সে নষ্টামি করতে হবেনা!

আমি স্বপ্ন দেখি, আল্লাহর ভয়ে নষ্টামি থেকে হেফাজত করে চলা অনুগত বান্দাদের কষ্টগুলো একদিন মুছে দিবেন। অন্তর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসগুলো একদিন ফুরিয়ে যাবে। একদিন নিশ্চয় অন্তরগুলো প্রশান্ত হবে। ততদিন পর্যন্ত নিশ্চয় সবাই আল্লাহ্‌র উপরই ভরসা করবে, আল্লাহকে ভয় করবে। তাক্বওয়ার পুরস্কার অনেক দামি হয়।

“আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি।” [১২:৮৬]