কতদিন হয়ে গেল কদম ফুল এনে দেয় না বাবা বৃষ্টির পরে, স্কুলের ফেরার পথে রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে থাকা কৃষ্ণচূঁড়া গাছের আগুনরাঙ্গা ফুলগুলো দেখে চোখ ভরে তাকিয়ে থাকি না, বেলি ফুলের তাজা সুবাস, বসন্তের সেই প্রথম মিষ্টি ঝিরিঝিরি বাতাস, শরতের ভোরের সাদা পাপড়ি - কমলা ডগার শিউলি ফুলের মালা গাঁথা, অনেকদিন হল এসব আর করা হয়না! আবার কবে হবে তাও জানিনা।

নিজের দেশটাকে ছেড়ে এলে এক অদ্ভুত ধরনের মায়া বোধ হয় দেশের প্রতি, আজব অবর্ণনীয় এক টান, একেই কি বলে দেশপ্রেম?! এর জন্যেই হয়ত বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া হাজার হাজার প্রবাসী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ আবার বাংলাদেশেই পাঠানো পছন্দ করেন, যদি এতে দেশের কোন উপকার হয়!

সত্যি বলতে এসব ছোট মুহূর্তগুলি জীবনের এতোই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয় যে মানুষ তা প্রতিনিয়ত উপভোগ করে, কিন্তু মর্ম অনুধাবন করে না। সৌন্দর্য অবলোকন করে চোখ জুড়ায়, তবে সাহিত্য রচনা করে না! একমাত্র দূরে থাকলেই বুঝা যায় ক্ষুদ্র কিন্তু এই ক্ষণিকের দৃশ্যগুলোর জন্য মন কীভাবে কাঁদে.... 

আকাশ কালো করে যখন বৈশাখের সেই প্রবল ঝড় হত, ভয়ে মন দুরুদুরু করত, ক্রমাগত দুআ পড়তে থাকতাম আমরা! না জানি কখন গাছগুলো কড়মড় করে ভেঙ্গে পড়ে! তবে সেই ভয়ঙ্কর বাতাসের তীব্র বেগে আজও এলোমেলো চুল উড়াতে ইচ্ছা করে! হাত বাড়িয়ে শিলা ধরতে মন চায়! কারেন্ট শর্ট সার্কিট হয়ে যখন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়, তখন সেই আঁধার আর ঝড়ের সজোর ঝাপটার সাথে মিশে যেতে চায় সমস্ত চেতনা! 

এই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যগুলো আমার কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। প্রবাস জীবন যে খুব অসুন্দর অনুপভোগ্য তা নয়! বরং মাঝে মাঝে পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ করে সোঁদা মাটির গন্ধ নিতে মন চায়! খুবই অদ্ভুত ইচ্ছা যদিও আমাকে মানতেই হবে! 

মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় সেই ঝুম বৃষ্টিতে আবার একটু ভিজতে পারতাম তাহলেই যেন জীবন সার্থক হত! জানি তা সত্যি না, তবু সেরকম মনে হয়! উল্টাপাল্টা এই স্বপ্নগুলো যে শুধুই আমার একার তা কিন্তু নয়; আমার বোন-ও দেখি মাঝে মাঝে একই কথা বলে! বলার সময় ওর চোখদুটি চিকচিক করতে থাকে! হয়ত আমার না-বলা এই ইচ্ছেগুলি যখন হঠাৎ হঠাৎ প্রকাশিত হয়, তখন আমার চোখেও অমন তীক্ষ্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রবল ছাপ থাকে, যা আমি দেখতে পাই না। হাস্যকর শোনাতে পারে আমার কথাগুলো! কিন্তু ছেলেবেলার জীবনে ফিরে যেতে সবারই যেমন অন্তত একবার হলেও ইচ্ছা হয়, ঠিক তেমনই আমরাও এই প্রবাসে থেকে সেই দুর্লভ কিছু মুহূর্তকে প্রচন্ডভাবে অনুভব করি! ঐসব যে পেয়ে গেলেই আমার জীবন এক্কেবারে সুখি হয়ে যাবে, সব ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে, সার্থক হয়ে যাবে, তা নাহ! তবুও ঐ মুহূর্তগুলো সব সময়-ই সেরা! 

কত অল্প সময়-ই না আমরা এই পৃথিবীতে থাকি! এই সব ছোটখাট ঘটনা চিরস্থায়ী কিছু না—তা তো সবার জানা! তারপরেও, কি দুর্বার আকর্ষণ থাকে এসবের প্রতি! আর কত অল্প সময়ের জন্যই না আমরা এসব পাই! ইচ্ছা করলেও হয়ত পেতে পারি না! প্রকৃতির হাতে! হায় কতই না সীমাবদ্ধ আমরা! এরকম করে ভাবলে অস্থির লাগে! আমরা ইচ্ছা করলেই অতীতে ফিরে যেতে পারি না, ভবিষ্যৎকে জেনে ফেলতে পারিনা, বর্তমানকে থামিয়ে রাখতে পারিনা, নিজের সীমার বাইরে কিছু করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা কতো দুর্বল। কিন্তু এটাই ধ্রুব সত্য। তারপরও আমরা আমাদের বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করি, একদিন যে মারা যাবই, ‘মৃত্যুর’ মত কঠিন সীমাবদ্ধতাকে আমরা বারবার ভুলে যাই! 

এই পৃথিবীতে ক’দিন-ই বা আছি! তাও এইটুক সুখের জন্য মন কাঁদে! আর চিরস্থায়ী যে সুখের স্থান, যেখানে মনের সব ইচ্ছা পূরণ হবে, কল্পনাতীত সুখে ভরা সেই অসম্ভব স্বপ্নময় জগতের কথা আমরা কতটাই বা ভাবি?! আল্লাহর সেই ওয়াদা করা জান্নাত! কতবার দিনে মনে করি আমরা সেই সৃষ্টিকর্তার কথা, যার কথা মেনে নিলে সেই অসীম সুখের জীবন মিলবে! তার জন্য কয়টা কাজ করি? শুধু নামাজ আর রমজানের রোজা মানেই আল্লাহর কথা শোনা নাহ! বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মেনে নেয়াই সঠিক ইসলাম। জন্মগতভাবে বা নামের মাধ্যমে কেউ মুসলিম হয়ে যেতে পারে না, ইসলামের আসল পরিচয় আমাদের কাজে। মনকে কী জিজ্ঞেস করে দেখি আমরা – আমরা কি আসলেও আল্লাহ-য় বিশ্বাসী? তাঁর ভয়ংকর শাস্তিতে? কেয়ামতের প্রবল আজাবে? তাহলে কেন তাঁর সব কথা মেনে নেই না? কীভাবে বলতে পারি, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিবে? যাকে আমি সারাজীবন আমার কোন কাজেই মনে রাখিনি! আল্লাহর কি এতোই ঠেকা আমাদের কাছে!

আল্লাহপাক বলেছেনঃ 

‘এরাই হল সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করেছে এবং (খরিদ করেছে) ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে আযাব। অতএব, তারা দোযখের উপর কেমন ধৈর্য্য ধারণকারী।’ [২ঃ১৭৫] 

আজ আমরাও ইসলামি জীবনের পরিবর্তে সুদ আর ঘুষের জীবন গ্রহণ করি। হিজাব আর মর্যাদার পোষাক ছেড়ে দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের পণ্য বেচাকেনার জন্য মডেলিং আর ফ্যাশনের জগৎ বেছে নেই! মা-বাবার কথা ভুলে যেয়ে গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড-ই হয়ে যায় জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যক্তি! কুরআনের আয়াতের চাইতে গান-ই বেশি উপভোগ্য লাগে! আল্লাহর কথা না শুনে শয়তানের কথা অনুযায়ী কাজে আনন্দ পাই! কি করে আমরা বলতে পারি তাহলে আমরা জান্নাতে যাব? শুধু ‘মুসলিম’ নামের বিনিময়ে? 

না, বরং আমরা যারা নামে আর কথায় এক রকম বিশ্বাস করি, এবং কাজে তার প্রতিফলন করি না—সেরকম (মুনাফিক) মানুষদের ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেছেনঃ

‘আপনি (মুহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন অথবা না করুন, উভয়ই সমান। আল্লাহ কখনও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।’ [৬৩ঃ৬]

সময় কি এখনও আসেনি যে আমরা একটু চিন্তা করে দেখি? ক্ষণকালের হাসিখেলার বিনিময়ে সীমাহীন জীবনের জন্য একবার ভাবি।। জীবন এভাবে কিন্তু চলতেই থাকবে, চলতে চলতে একসময় সময় শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ততদিনে কি অনেক দেরি হয়ে যাবে না? কতো মানুষ এরকম পরে চিন্তা করার কথা ভেবে আর সুযোগ পাইনি তা নিয়ে ভাবার! আমাদের দাদা-নানা-মা-বাবা ভেবে দেখি তো, ওরা কি বয়সের সাথে সাথে ইসলামের জন্য জীবনের কথা ভেবে খুব চিন্তিত হয়েছে? তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করে ফেলেছে হঠাৎ একদিনে? না, তা হয় না। সময় এখনই ... শুধু বিশ্বাস স্থাপন নয়, বরং কাজে মুসলিম হওয়ার...

আর আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলা বলেনঃ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আমি তাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করাব, যেগুলোর তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা চিরকাল তথায় অবস্থান করবে। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সত্য সত্য। আল্লাহর চাইতে অধিক সত্যবাদী কে?’ [৪ঃ১২২] 

আমি জান্নাতে যেতে চাই, জান্নাতের প্রতিও আমার দুর্বার আকর্ষণ! এই ধুলি-ধূসরিত পৃথিবীতে কিছু পাই বা না পাই, কিছু ধরে রাখতে পারি বা না পারি, সেই চিরস্থায়ী আবাসস্থলে যেন পছন্দের মানুষগুলো মিলে হাসি-আনন্দে থাকতে পারি সেই স্বপ্ন দেখে আমি তার জন্য কাজ করে যাই...


Tuesday, 6 March 2012 at 20:14